শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা উন্মোচন করল এসএসসির ফল

মো. ফেরদাউস মোবারক
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৯: ৪১
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে এসএসসি পরীক্ষার ফল নিয়ে দেশজুড়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। পাসের হার ১৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম—মাত্র ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এই ফলাফল যেনো স্পষ্ট করে দিয়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গভীর সংকট।

২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৮৩.০৪ শতাংশ, এ বছরের এই নাটকীয় পতন অশনি সংকেত বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

কমেছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। গত বছরের এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯, এবার কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জনে। এটি একটি বড় সতর্কবার্তা। এটা শুধু বিদ্যমান দুর্বলতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আগের বছরগুলোতে কৃত্রিমভাবে ফলাফল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলার প্রবণতাও স্পষ্ট করেছে— যার ফলে অনেক কাঠামোগত সমস্যাই আড়ালে থেকে গিয়েছিল। বাস্তবতা হলো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে।

দেশের ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডেই পাসের হার নেমে এসেছে ৬৮.০৪ শতাংশে। অকৃতকার্য হয়েছে ৬ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। ঢাকা বোর্ডে ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৮৯.৩২ শতাংশ, ২০২৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৭.৫১ শতাংশে। যশোর বোর্ড বরাবরই ভালো ফলাফলের জন্য পরিচিত, এ বোর্ডেরও পাসের হারও কমে এসেছে ৯২.৩৩ শতাংশ থেকে ৭৩.৬৯ শতাংশে। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো, এবারে ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউই পাস করেনি। এর বিপরীতে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২,৯৬৮ থেকে কমে মাত্র ৯৮৪-তে নেমে এসেছে। এসব পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দিচ্ছে—সমস্যাটা কেবল শিক্ষার্থীর বা একটি-দুটো প্রতিষ্ঠানের নয়, বরং গোটা শিক্ষাব্যবস্থারই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিনুর রশীদের মতে, এ পতনের পেছনে একাধিক কারণ আছে—খারাপ প্রস্তুতি, সাম্প্রতিক শিক্ষার্থী আন্দোলন, আর্থসামাজিক সংকট ইত্যাদি। তবে তাঁর মতে, সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে সরকারি নীতিতে—ফলাফল কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখানোর প্রচেষ্টা থেকে সরকার সরে এসেছে। বছরের পর বছর ধরে ফলাফল বাড়িয়ে, জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়িয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রচার চালানো হয়েছে। কিন্তু ২০২৫ সালের ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে, সেই ‘অগ্রগতি’ ছিল অনেকটাই ভ্রান্ত।

পূর্ববর্তী সরকার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতির চিত্র দেখাতে চেয়েছে, কিন্তু এতে বাস্তব শিক্ষার মান যে কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে, তা চাপা পড়ে গিয়েছিল। এই ‘সংখ্যার সাফল্য’ শিক্ষার গুণমানের চেয়ে কেবল বাহ্যিক অর্জনকেই গুরুত্ব দিয়েছে। ফলাফল বাড়ানোর এই প্রবণতা এমন এক বিষাক্ত প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যা শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ বাড়িয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটেছে।

ফলাফল কৃত্রিমভাবে উন্নত দেখাতে গিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার অনেক গভীর সমস্যা আড়াল হয়ে গিয়েছিল। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা কোভিড-১৯ মহামারির কারণে প্রায় নিয়মিতভাবেই শ্রেণিকক্ষে পাঠ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একাধিক বছর ধরে এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে শিক্ষার্থীরা যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেনি। ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় তুলনামূলক স্বচ্ছ ও কঠোর মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হওয়ায় সেই দুর্বল ভিত্তি প্রকাশ্যে এসেছে—যা এতদিন চাপা ছিল।

এই ফলাফল কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত শিক্ষাগত সংকটের বহিঃপ্রকাশ। এখানে একাধিক বড় চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

শিক্ষা কার্যক্রমে ঘন ঘন বিঘ্ন শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, জুলাইয়ের ছাত্র-আন্দোলনের মতো ঘটনা শিক্ষার ধারাবাহিকতা ব্যাহত করেছে। মহামারির সময় অনলাইন শিক্ষায় চলে যাওয়ার ফলে বৈষম্য আরও বেড়ে যায়, কারণ গ্রামীণ এলাকার অনেক শিক্ষার্থীরই প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি বা ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না। এই ডিজিটাল বিভাজন এখনো শিক্ষার সাম্য প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা।

পাঠ্যসূচির দিক থেকেও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর তীব্র সমালোচনা রয়েছে। মুখস্থনির্ভরতা, বিশ্লেষণী ও ব্যবহারিক জ্ঞানকে উপেক্ষা করে এমন শিক্ষানীতি শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের জন্য অপ্রস্তুত করে তোলে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের ঘাটতি এবং পুরনো, অপ্রাসঙ্গিক শিক্ষাদান পদ্ধতি শিক্ষার মান আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

দারিদ্র্য, পিতামাতার সহযোগিতার অভাব, এবং বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর দুর্বল অবকাঠামো শিক্ষার্থীদের সফলতার পথে বড় বাধা। যে ১৩৪টি স্কুলে কেউই পাস করতে পারেনি, সেগুলোর বেশিরভাগই হয়তো পর্যাপ্ত সংস্থানহীন।

উচ্চ ফলাফলের পেছনে ছোটা এবং তীব্র প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অতীতের ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা ফলাফল এমন এক চাপ তৈরি করেছে, যার ফলে অনেকেই হতাশায় ডুবে গেছে—কখনো কখনো শিক্ষার্থীরা প্রাণঘাতী সিদ্ধান্তও নিয়েছে।

২০২৫ সালের এসএসসি ফলাফল শিক্ষাখাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নাড়া দেওয়ার মতো একটি সতর্কবার্তা। যদিও এ ফলাফল হতাশাজনক, তবে এটি সত্য মেনে নেওয়ার এবং সংস্কারের পথ খুঁজে বের করার সুযোগ এনে দিয়েছে। এখন সময় এসেছে ফাঁপা সংখ্যার পেছনে না ছুটে বাস্তব শিক্ষার মান উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়ার—শিক্ষার্থীদের মানসিক ও একাডেমিক সুস্থতা নিশ্চিত করার।

সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছু মূল ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মুখস্থনির্ভর পাঠ্যসূচির পরিবর্তে বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান এবং ব্যবহারিক দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা ও কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত থাকে। শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে তাঁরা সময়োপযোগী পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করতে পারেন এবং শিক্ষালয়কে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলতে পারেন।

বৈষম্য দূর করাও জরুরি। কম-সংস্থানযুক্ত বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ডিজিটাল শিক্ষায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে শহর-গ্রামের ব্যবধান কমানো দরকার। মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা অবশ্যই শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ হতে হবে—পরামর্শ সেবা ও ফলাফলের বাইরেও সফলতার ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

মূল্যায়নে স্বচ্ছতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় দেখা যে স্বচ্ছ ও কঠোর মূল্যায়ন পদ্ধতির সূচনা হয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে ফলাফল সত্যিকারের শিক্ষাগত অর্জনকে প্রতিফলিত করে।

স্বচ্ছ মূল্যায়নের এই পদক্ষেপ শিক্ষাক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক মোড় হলেও, তা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে—পিছিয়ে পড়া শিক্ষার মান। এই মুহূর্তকে পরিবর্তনের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে—গুণগত শিক্ষা, সাম্য, ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিত্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।

লেখক : সাংবাদিক।

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

প্রাইম ব্যাংকে চাকরি, স্নাতক পাসেই আবেদন

১ ঘণ্টা আগে

জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে একমত হয়েছে দলগুলো

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের বৈঠকে ১২তম দিনে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। সিদ্ধান্ত হয়েছে, জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা। মন্ত্রীসভার বৈঠকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বা নেত্রী বা তার অনুপস্থিতি

১ ঘণ্টা আগে

ফের বাড়লো সেনাবাহিনীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা আরও ২ মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে পরবর্তী ৬০ দিন পর্যন্ত তারা সারাদেশে এ ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবেন।

১ ঘণ্টা আগে

শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে মোদিকে আম পাঠাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

নয়াদিল্লি পৌঁছানোর পর আমগুলো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, কূটনীতিক এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যেও বিতরণ করা হবে— মৈত্রীর অংশ হিসেবে।

৩ ঘণ্টা আগে