পুঁজিবাজার নতুন আশাবাদ: সম্ভাব্য ঝুঁকি

ফজলুল বারী
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ৩৮

গত সপ্তাহে পুঁজিবাজারের সব সূচকেরই ধনাত্মক পরিবর্তন ঘটে। এর অন্যতম কারণ নতুন বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ এবং নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশের সক্রিয় হওয়া। বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীদের সতর্ক ক্রয় কর্মকাণ্ডও ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং ব্রোকারেজ হাউসগুলো লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে। এতে বাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নতুন আশাবাদ তৈরি হয়েছে।

তবে এই আশাবাদের মাঝেই রয়েছে শঙ্কা। প্রধান শঙ্কার জায়গা হলো—বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং কয়েকটি ‘ব্যাংক-ব্যাকড’ প্রাতিষ্ঠানিক ব্রোকারেজ হাউস। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার-বিনাশী কর্মকাণ্ডের কারণে বিনিয়োগ ঝুঁকি বহুগুণ বেড়েছে বলে মনে হয়। বিশেষ করে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের বিনিয়োগ-বিনাশী ভূমিকার বিভিন্ন তথ্য সবিস্তারে একাধিকবার লিখেছি।

আজকের লেখায় আসন্ন ঝুঁকির বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করছি। প্রথমেই উল্লেখ্য—পুরোনো বিনিয়োগ পুঁজির সুরক্ষা বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপকরা দিতে পারেনি। এ অবস্থায় নতুন পুঁজির সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত হবে? বাজার ব্যবস্থাপকরা এ বিষয়েও কোনো প্রতিশ্রুতি বা দিকনির্দেশনা দেয়নি। বরং বিনিয়োগ পুঁজির ঝুঁকির জায়গাটি আরও প্রকট করেছে। ইতোমধ্যেই প্রস্তাবিত নতুন মার্জিন রুল বাজারে অস্থিরতার তাপ ছড়াতে শুরু করেছে।

বাজার ব্যবস্থাপকরা পুরোনো ইকুইটি মাইনাস অ্যাকাউন্টগুলোর কোনো বিনিয়োগবান্ধব সমাধান দেয়নি। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় মার্জিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের শক্তি বাড়ানো হলেও ক্যাসিনো বাজারের আওতা বিস্তৃত হয়েছে। বেড়েছে ফোর্স সেলের পরিধিও। ফোর্স সেল মানে হলো—জোর করে বাজারকে মন্দামুখী করা। মন্দার সময় মার্জিন ও নন-মার্জিন উভয় ধারার বিনিয়োগকারীর পুঁজি লোপাট হয়। লাভবান হয় কেবল কিছু ‘ব্যাংক-ব্যাকড’ ব্রোকার হাউস।

গত সাড়ে ১৬ বছর যাবৎ পুঁজিবাজারে মন্দা চললেও স্টক এক্সচেঞ্জসহ সব ব্রোকারেজ হাউসই লোকসানে ছিল এতদিন। কিন্তু পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন লোকসানে থাকলেও ক্যাসিনো-সংগঠক কর্মকর্তাদের বিলাসিতা কিন্তু কমেনি; বরং বেড়েছে। যারা একসময় পায়ে হেঁটে মতিঝিলসহ সর্বত্র ঘুরে বেড়াত, তারা এখন কোটি কোটি টাকা দামের একাধিক গাড়িতে চলাফেরা করছে। কারও বিদেশে বাড়ি আছে, ব্যবসা আছে। তারাই ফোর্স সেলের মাধ্যমে সূচক নামিয়ে দাবি আদায় করে, বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করে কবরস্থান ও শ্মশান ঘাটের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। মার্জিন ফাঁদে পুঁজি হারিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ বিনিয়োগকারী নিঃস্ব অবস্থায় বাজার ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

এ তথ্য পুরোনো। নতুন হলো—বিদ্যমান ব্যবস্থা বজায় থাকলে বর্তমান ১৩ লাখ বিনিয়োগকারীসহ নতুন বিনিয়োগকারীর পুঁজিও ঝুঁকিতে পড়বে। আর ক্যাসিনো সংগঠকদের বিলাসিতা আরও বাড়বে।

সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রথমেই প্রয়োজন—‘মার্জিন ক্যান্সার’ মুক্ত পুঁজিবাজার প্রতিষ্ঠা করা। জরুরি হলো বিনিয়োগ পুঁজির সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আরও জরুরি হলো বাজার ব্যবস্থাপকদের কারণে যেন বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার নিশ্চয়তা দেয়া। ঘনঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বন্ধ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগনীতি নিশ্চিত করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপকদের কারণে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায়ভার বাজার ব্যবস্থাপককেই নিতে হবে এবং ক্ষতিপূরণও দিতে হবে। বাজার থেকে সব বৈষম্য ও হয়রানি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও প্রত্যাশিত।

বৈষম্যের একটি উদাহরণ হলো—বর্তমানে এসএমই মার্কেটের আটটি কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা বা তার বেশি। এসএমই বিধি অনুযায়ী এগুলো মূল মার্কেটে আসার যোগ্য। কিন্তু সেগুলো মূল মার্কেটে উঠতে পারছে না। অন্যদিকে মূল মার্কেটের ৫১টি কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটির নিচে হলেও তারা মূল মার্কেটে টিকে আছে। অবশ্যই এসএমইতে থাকা আটটি কোম্পানিকে মূল মার্কেটে আনতেই হবে এমন দাবি করছি না। তবে কেন এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

ডিএসই কোনো শেয়ারের দাম বাড়লে চিঠি দিয়ে কারণ জানতে চায়, নানাভাবে হয়রানি করে। কিন্তু দাম পড়লে নীরব থাকে! কেন এই বৈপরীত্য? ডিএসইর লক্ষ্য কি মুনাফা-বিরোধী অবস্থান নেয়া?

গত সপ্তাহে ডিএসইর পরিসংখ্যান অনুযায়ী—২৪৩টি কোম্পানির দাম বেড়েছে, ১২৬টির দাম কমেছে, ২২টির দাম অপরিবর্তিত ছিল এবং আরও ২২টি সিকিউরিটিজ কোনো লেনদেনে অংশ নেয়নি। তালিকাভুক্ত অধিকাংশ শেয়ারের দাম বাড়ায় ডিএসইর তিনটি সূচকই ধনাত্মক পরিবর্তন দেখায়। তবে ডিএসএমইএক্স সূচক ঋণাত্মক পরিবর্তন হয়েছে। সপ্তাহ শেষে ডিএসইএক্স সূচক দাঁড়ায় ৫৬১৪ পয়েন্টে। এ অবস্থান সাত হাজার পয়েন্ট থেকে ১৩৮৬ পয়েন্ট কম এবং প্রত্যাশিত ১০,০০০ পয়েন্ট থেকে ৪৩৮৬ পয়েন্ট কম।

মূল্য সূচক প্রত্যাশার চেয়ে অনেক নিচে হলেও লেনদেনের প্রবৃদ্ধিতে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর কর্তা ব্যক্তিরা সন্তুষ্ট। বহু বছর পর তারা মুনাফার মুখ দেখতে শুরু করেছে। শ্যামল ইকুইটিজ মুনাফা প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে নিজ হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইনসেনটিভ বোনাস দিয়েছে। অপ্রত্যাশিত এ বোনাস পেয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা খুশিতে ‘বাকবাকুম’।

খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়—তালিকাভুক্ত ২১ খাতের মধ্যে ১৬টি খাত সবুজ এবং পাঁচটি খাত লালে ছিল। লেনদেনেও একই চিত্র ছিল। দাম বৃদ্ধির শীর্ষ দশ তালিকায় মাত্র দুটি ছিল ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত। বাকিগুলোর মধ্যে চারটি ‘বি’ এবং চারটি ‘জেড’ শ্রেণির শেয়ার। অন্যদিকে লেনদেনের শীর্ষ দশ তালিকায় একটি ছাড়া বাকিগুলো ছিল ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত। অর্থাৎ মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ারের প্রতি ক্রেতার আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক

ad
ad

অর্থের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

দেশের ১ নম্বর টিস্যু ব্র্যান্ড বসুন্ধরা টিস্যু

বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের বেস্ট ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ডের ১৭তম আসরে জরিপের ভিত্তিতে টিস্যু ক্যাটাগরিতে এবারও বেস্ট ব্র্যান্ড হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে বসুন্ধরা টিস্যু।

৫ দিন আগে

৭০০ বিলিয়ন ডলারের চূড়ায় মাস্ক, ইতিহাসে প্রথম

বিশ্বের সম্পদশালীদের তালিকায় শীর্ষে থাকা টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক আবারও এক ইতিহাস গড়লেন। শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের পর তার মোট সম্পদের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

৫ দিন আগে

সব রেকর্ড ভাঙল স্বর্ণের দাম

এ ছাড়া ১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম এক লাখ ৭৮ হাজার ৪৫৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনার দাম এক লাখ ৪৮ হাজার ৫৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অপরিবর্তীত আছে রুপার দাম। ২২ ক্যারেটের রুপার ভরি চার হাজার ২৪৬ টাকা।

৬ দিন আগে

আরও ৬ কোটি ডলার কিনল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

তিনি বলেন, চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ছয় কোটি মার্কিন ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের বিনিময় হার ছিল ১২২ টাকা ৩০ পয়সা। কাট অফ মূল্য ছিল ১২২ টাকা ৩০ পয়সা।

৬ দিন আগে