ইতিহাস

গোপাল ভাঁড়কে কেন ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

বাংলার লোকসংস্কৃতিতে গোপাল ভাঁড় এমন এক নাম, যা শুনলেই মানুষের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তিনি ছিলেনতীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সাহস, এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার এক অনন্য উদাহরণ। তাঁর আসল নাম গোপাল চন্দ্র প্রামাণিক। ১৮শ শতকের মধ্যভাগে তিনি নদীয়ার কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে রাজবিদূষক হিসেবে খ্যাতি পান। কথিত আছে, গোপাল শুধু রাজাকে নয়, পুরো দরবারকেই হাসাতেন, কিন্তু তাঁর কৌতুকের আড়ালে থাকত গভীর রাজনৈতিক ইঙ্গিত।

এই সময় বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তাল। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন তৎকালীন বাংলার শাসক, কিন্তু ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছিল। অনেক জমিদার ও ক্ষুদ্র রাজারা একদিকে নবাবের অধীনে থেকে, অন্যদিকে ইংরেজদের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখছিলেন নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বলে ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়। বিদেশি ইতিহাসবিদ ডেভিড লুডেন তাঁর ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার বইয়ে লিখেছেন, “বাংলার বহু জমিদার দুই দিকেই যোগাযোগ রাখ—নবাবের সঙ্গে থাকত আবার ইংরেজদের কাছ থেকেও সুবিধা নিত।” এই পরিস্থিতি গোপাল ভাঁড় খুব ভালোভাবে বুঝতেন। তিনি একদিন রাজাকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ইংরেজরা প্রথমে সুচের মতো ঢুকবে, কিন্তু পরে কুড়ালের মতো আঘাত করবে। এই রূপক বাক্যের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ইংরেজদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে।

তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপালের পরামর্শকে গুরুত্ব দেননি, বরং মজা করে তাঁকে একদিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। তিনি বললেন, “তুমি যদি নবাব সিরাজউদ্দৌলার সামনে গিয়ে ভেংচি দাও, তবে আমি ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব।” কথাটা ছিল ঠাট্টার ছলে বলা, কিন্তু গোপাল ভাঁড় এই চ্যালেঞ্জকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করলেন। তিনি বুঝেছিলেন, কখনো কখনো রাজনৈতিক সত্যকে প্রকাশ করতে নাটকীয় কিছু করতে হয়, আর তাঁর জন্য ভেংচির মতো অদ্ভুত কাণ্ডও গ্রহণযোগ্য।

নবাবের প্রাসাদে ঢোকার সময় প্রহরীরা গোপালকে আটকায়। তখন তিনি এক প্রহরীর হাতে কামড় দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন। নবাবের সামনে গিয়ে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে বারবার ভেংচি দিলেন। নবাব এই অপমান সহ্য করতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির আদেশ দিলেন। ইংরেজ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল এই ঘটনার প্রসঙ্গে এক বক্তৃতায় বলেছেন, “বাংলার দরবারি বিদূষকরা কখনও কখনও এমন সাহসী কাণ্ড করতেন, যা তাঁদের প্রাণহানির কারণ হতে পারত, কিন্তু তাঁরা তাতে ভয় পেতেন না।” নবাবের রাগ তখন তুঙ্গে, আর গোপালকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলতে লাগল।

পরদিন গোপালকে জনসমক্ষে ফাঁসির মঞ্চে আনা হলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তিনি একটুও ভীত নন, বরং ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আবারও ভেংচি দিলেন। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবাই বিস্মিত হয়ে গেল। নবাবও অবাক হয়ে ভাবলেন, মৃত্যুর মুখেও যে মানুষ হাসতে পারে, সে হয় পাগল, নয়তো ভীষণ সাহসী। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ড. রুথ ভ্যানিতা এই বিষয়ে বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ার লোককথায় দেখা যায়, প্রকৃত শক্তি বলপ্রয়োগে নয়, বরং মনের দৃঢ়তায়। গোপাল ভাঁড়ের কাহিনি সেই মানসিক শক্তিরই উদাহরণ।” নবাব শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, গোপালকে ফাঁসি দেওয়া হবে না। তিনি ঘোষণা করলেন, “এ লোক পাগল! ওকে ছেড়ে দাও।”

মুক্তি পেলেও গোপাল আর কৃষ্ণনগরের দরবারে ফিরলেন না। রাতের আঁধারে তিনি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর তাঁর জীবন নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে—কেউ বলেন, তিনি অন্য রাজ্যে চলে গিয়ে শান্ত জীবনযাপন করেন, কেউ বলেন, তিনি গ্রামে ফিরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকতেন। বিদেশি লোকসংস্কৃতি গবেষক সারা স্নোডেন তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, “গোপাল ভাঁড়ের কাহিনি শুধু হাসির গল্প নয়, বরং রাজনৈতিক সতর্কবার্তাও বটে। তাঁর ভেংচি ছিল এক ধরনের প্রতিবাদের ভাষা, যা শাসকের ক্ষমতার সামনে মানুষের স্বাধীন চিন্তার পরিচয়।”

আজও গোপাল ভাঁড় বাংলার লোকস্মৃতিতে জীবিত। তাঁর গল্পে শুধু হাসি নয়, রয়েছে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সাহস আর সত্য বলার দৃঢ়তা। নবাব সিরাজউদ্দৌলার দেওয়া ফাঁসির আদেশ হয়তো বাস্তবে কার্যকর হয়নি, কিন্তু সেই ঘটনা গোপাল ভাঁড়কে কিংবদন্তির মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—সত্য বলার জন্য কখনও কখনও মজার ছলও কার্যকর হতে পারে, আর সাহস থাকলে শাসকের চোখেও চোখ রাখা সম্ভব।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

সুখবর পেলেন বিএনপির ২৮ নেতা

এতে বলা হয়েছে, ইতোপূর্বে হবিগঞ্জ জেলাধীন চুনারুঘাট উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সৈয়দ লিয়াকত হাসান স্বেচ্ছায় দল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে।

১৯ ঘণ্টা আগে

মৃত্যুদণ্ডই শেখ হাসিনার উপযুক্ত বিচার : আখতার

ভিডিও বার্তায় আখতার হোসেন বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডই শেখ হাসিনার জন্য উপযুক্ত বিচার। এই রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ন্যায়বিচার করা সম্ভব হবে। সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এই রায় সরকারকে কার্যকর করতে হবে।’

১৯ ঘণ্টা আগে

ধৈর্য, সতর্কতা ও ঐক্য বজায় রাখুন : জামায়াত আমির

পোস্টে তিনি আরও লিখেছেন, এই সংকটময় সময়ে আমি আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- আমাদের সংগ্রাম কারও বিরুদ্ধে নয়, আমাদের সংগ্রাম ন্যায়, অধিকার, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে। আমরা চাই এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে সব নাগরিক নিরাপদে মত প্রকাশ করতে পারে, যেখানে বিচার হবে নিরপেক্ষ এবং যেখানে পরিবর্তন আসবে শান্তিপূর্ণ

১৯ ঘণ্টা আগে

রাতে বৈঠকে বসছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি

দলীয় সূত্রের তথ্যানুযায়ী, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া অস্থিরতা, বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ–অসন্তোষের পরিস্থিতি এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা, এসব ইস্যু আজকের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।

২০ ঘণ্টা আগে