ইতিহাস

বারো ভুঁইয়া কারা ছিলেন?

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

বাংলার ইতিহাসে একটি আকর্ষণীয় ও অনন্য সময়ের নাম “বারো ভূঁইয়া” যুগ। এটি মূলত ষোড়শ শতকের শেষভাগ থেকে সপ্তদশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই সময়ে বাংলায় এক ধরনের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও কেন্দ্রীয় দুর্বলতার সুযোগে কিছু প্রভাবশালী সামন্ত রাজা ও জমিদার নিজেদের অঞ্চলগুলোতে স্বাধীনভাবে শাসন শুরু করেন। তারা মোঘল শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক আলাদা পরিচিতি তৈরি করেন। ইতিহাসে এদের “বারো ভূঁইয়া” নামে অভিহিত করা হয়, যদিও এই সংখ্যাটি প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় প্রতীকী ছিল বলে গবেষকরা মনে করেন।

বারো ভূঁইয়ারা ছিলেন এক ধরনের আঞ্চলিক ক্ষমতাবান জমিদার বা সামন্তশাসক, যারা মূলত বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকার উত্তর, বিক্রমপুর, সোনারগাঁ, বাঘরাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নামটি হলো ঈশা খাঁ। তিনি ছিলেন বারো ভূঁইয়াদের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি, যিনি মোঘলদের বিরুদ্ধে একাধিকবার সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এবং বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।

ঈশা খাঁ ছিলেন আফগান বংশোদ্ভূত এবং তাঁর পরিবার বাংলায় আফগান শাসকদের সহযোগী হিসেবে এসেছিল। পরে তিনি বিক্রমপুর ও ভূঞাপুর অঞ্চলে নিজের শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলেন এবং বহু ছোট রাজা ও ভূঁইয়াদের একত্রিত করে এক ধরনের সামরিক জোট গঠন করেন। এই জোটই বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে ঐতিহাসিকরা প্রায়ই বলে থাকেন যে এই "বারো" সংখ্যাটি প্রকৃত সংখ্যা নির্দেশ করে না, বরং এটি একটি সাংকেতিক সংখ্যা, যার মাধ্যমে অনেকগুলো আঞ্চলিক শাসকের জোটকে বোঝানো হয়েছে।

ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া-তে লিখেছেন, “বারো ভূঁইয়াদের এই জোট ছিল এক দুর্দান্ত উদাহরণ, যেখানে একাধিক আঞ্চলিক শক্তি সম্মিলিতভাবে এক বিশাল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।” এই মন্তব্যে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বারো ভূঁইয়া কেবল একগুচ্ছ জমিদার ছিলেন না, বরং তারা ছিলেন এক ধরনের রাজনৈতিক আদর্শের ধারক, যারা শাসন ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন।

বারো ভূঁইয়ার ইতিহাস গভীরভাবে জড়িত মোঘল সাম্রাজ্যের বাংলা অভিযানের সাথে। সম্রাট আকবর বাংলাকে মোঘল শাসনের অধীনে আনতে চাইলে বারো ভূঁইয়ারা তাতে প্রতিবাদ করেন। তারা যুদ্ধ করেন তদানীন্তন মোঘল সেনাপতি খাঁনজাহান ও মানসিংহের নেতৃত্বে আসা মোঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে। ১৫৭৮ থেকে ১৫৯৯ সালের মধ্যে বহু সংঘর্ষ, যুদ্ধ ও সন্ধির মধ্য দিয়ে এই প্রতিরোধ পর্ব চলতে থাকে।

ঈশা খাঁর সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তা তাঁকে মোঘলদের কাছেও একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি মাঝে মাঝে কৌশলগত সন্ধিতে যান আবার প্রয়োজনে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তাঁর মৃত্যুর পর বারো ভূঁইয়া জোটটি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ে। তার পুত্র মুসা খাঁ এর শাসনামলে মোঘলরা বারো ভূঁইয়া জোটকে ভেঙে দেয় এবং বাংলাকে তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

ঐতিহাসিক রিচার্ড এম. ইটন তাঁর গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, “বারো ভূঁইয়া ব্যবস্থা ছিল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক সেতুবন্ধন, যা আফগান শাসনের পতন এবং মোঘল আধিপত্যের উত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে কার্যকর ছিল।” এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে বারো ভূঁইয়ার যুগ ছিল কেবল প্রতিরোধের গল্প নয়, বরং এটি ছিল বাংলার রাষ্ট্র গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

এই ভূঁইয়ারা সাধারণত তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে স্বশাসিত শাসন কায়েম করেছিলেন। তাঁরা কর আদায় করতেন, নিজস্ব বাহিনী গঠন করতেন এবং স্থানীয় মানুষের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল দৃঢ়। কেউ কেউ ধর্মীয় নেতা হিসেবেও সম্মানিত ছিলেন। যেমন, ঈশা খাঁ ছিলেন সুফি ও ইসলামি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। তাঁর সময়ে মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের সহাবস্থানের পরিবেশ দেখা যায়, যা বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

বারো ভূঁইয়ার তালিকা সব সময় এক নয়, বিভিন্ন উৎসে বিভিন্ন ভূঁইয়ার নাম পাওয়া যায়। কিছু সাধারণভাবে স্বীকৃত নাম হলো: ঈশা খাঁ (বিক্রমপুর), কালিদাস রায় (জয়নগর), চন্দ রায় ও কেদার রায় (বিক্রমপুর ও সর্বদিয়া), মুকুন্দরাম (সোনারগাঁ), রাজনারায়ণ (চট্টগ্রাম), আনন্দ মজুমদার (ভবালগড়), রামচন্দ্র বসু (ভবানীপুর), এবং আরও অনেকে। এদের মধ্যে কিছু হিন্দু আর কিছু মুসলমান ছিলেন। এই বৈচিত্র্য বাংলার বহুত্ববাদী ইতিহাসের এক প্রমাণ।

ঐতিহাসিক জেমস টড তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেন, “বারো ভূঁইয়ার সময়ে বাংলার সমাজ-রাজনীতি গড়ে উঠেছিল সামরিক সাহসিকতা, কৃষিভিত্তিক শাসন এবং স্থানীয় জনসমর্থনের উপর।” এই সময়ে কৃষিকাজ ও নদীভিত্তিক বানিজ্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং ভূঁইয়ারা এসব নিয়ন্ত্রণ করে তাঁদের অর্থনৈতিক ভিত শক্ত করতেন।

বারো ভূঁইয়া যুগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল স্থানীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা। এই সময়ে বাংলা সাহিত্য, সংগীত, স্থাপত্য ও লোকধর্মের বিকাশ ঘটে। বহু সুফি দরগা, মসজিদ ও হিন্দু মন্দির নির্মিত হয়। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির পেছনে বারো ভূঁইয়াদের অবদান অস্বীকার করা যায় না।

বারো ভূঁইয়া যুগ শেষ হয়ে গেলেও এই অধ্যায়টি ইতিহাসে এক গর্বময় প্রতিরোধ, আঞ্চলিক ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতীক হিসেবে থেকে গেছে। এই ইতিহাস বাংলার জনগণের আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আজকের প্রজন্মের কাছে বারো ভূঁইয়ারা শুধুই অতীত নন, বরং এক অনুপ্রেরণা, যারা নিজেদের জমিন ও জনতার অধিকার রক্ষায় মাথা নত না করে যুদ্ধ করেছিলেন।

বিশ্বের অনেক ইতিহাসবিদ এই অধ্যায়কে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বিকাশের একটি ব্যতিক্রমী নিদর্শন হিসেবে দেখেন। বারো ভূঁইয়ারা প্রমাণ করেছিলেন, স্থানীয় জনসমর্থন এবং আঞ্চলিক ঐক্য থাকলে বড়ো সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও দীর্ঘদিন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। এবং এই শিক্ষা কেবল অতীত নয়, বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক।

বাংলার ইতিহাসের এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়টি শুধু যুদ্ধের নয়, সাহস, সম্মান, কূটনৈতিক চাতুর্য ও সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বারো ভূঁইয়াদের প্রতিটি নাম যেন বাংলার মাটিতে খোদাই হয়ে আছে স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

শেষ দিনে ৪৪২-সহ ডাকসুর মনোনয়ন সংগ্রহ ৫৬৫ প্রার্থীর

ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক জসীম উদ্দিন বলেন, সপ্তম দিনে ডাকসুর বিভিন্ন পদে জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছে ৪৪২ জন। এখন পর্যন্ত সাত দিনে ডাকসুতে মোট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ৫৬৫ জন এবং ১৮টি হল সংসদের জন্য মোট মনোনয়ন সংগ্রহ করেছে এক হাজার ২২৬ জন।

১৩ ঘণ্টা আগে

ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসের ইতিহাস

ইংল্যান্ডের সিংহাসন তখন ছিল এক জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। ইংরেজ রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর ১০৬৬ সালের জানুয়ারিতে উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল—কে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন? রাজ্যের প্রধান অভিজাতেরা হ্যারল্ড গডউইনসনকে রাজা ঘোষণা করলেন।

১৩ ঘণ্টা আগে

ডাকসুতে শিবিরের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম, জিএস পদে ফরহাদ

ডাকসুকে ভিপি পদে প্রার্থী সাদিক কায়েম শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি। অন্যদিকে জিএস পদে প্রার্থী এস এম ফরহাদ শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান সভাপতি।

১৫ ঘণ্টা আগে

ডাকসুতে শিবিরের প্যানেল ঘোষণা, নেতৃত্বে যারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিবিরের সাবেক সভাপতি সাদেক কায়েমকে ভিপি ও বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদকে জিএস করে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা করেছে সংগঠনটি।

১৮ ঘণ্টা আগে