মতামত

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ

রাজু আলীম
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৫৪

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হলো তৈরি পোশাক শিল্প—যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের উৎস। এ শিল্পের অন্যতম প্রধান বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করা হয়। ঠিক এমন একটি সময়ে, ২০২৫ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের উপর ৩৫% আমদানি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, যা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্কে তাৎক্ষণিক সংকেত এবং দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত তৈরি করে।

এই সিদ্ধান্তের পেছনে একটি বড় রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক পটভূমি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় নির্বাচনের পর একটি ‘America First’ নীতির নবায়ন ঘটান, যেখানে তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের উপর ‘reciprocal tariff’ আরোপের কথা বলেন—অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যে হারে শুল্ক দেয়, সেই হারে আমদানিকৃত পণ্যেও শুল্ক বসানো হবে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ৩৫% শুল্কের আওতায় আনা হয়, যদিও কিছু বিশ্লেষকের মতে, এটি রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করা সম্ভব।

এই শুল্ক কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক শিল্প। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার, যেখানে বছরে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। বর্তমানে এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় শুল্কমুক্ত বা স্বল্প শুল্কে প্রবেশ করত। কিন্তু ৩৫% শুল্ক আরোপের ফলে রপ্তানিকারকদের জন্য পণ্যের দাম প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে। ক্রেতারা সস্তা ও সহজলভ্য বিকল্প খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে অন্য দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ভারত, কিংবা মেক্সিকোর দিকে ঝুঁকতে পারেন। এর ফলস্বরূপ বাংলাদেশের অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং কয়েক লাখ শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন।

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান BGMEA এবং BKMEA ইতোমধ্যেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, এই শুল্ক শুধু পোশাক শিল্পে নয়, বরং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং, পরিবহন, প্যাকেজিং এবং রফতানি লজিস্টিক খাতেও ধস নামাবে। ফলে জাতীয় অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি হার হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি এই শুল্ক রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অন্যতম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী এবং দাতা দেশ। কিন্তু সম্প্রতি মানবাধিকার, শ্রমনীতি এবং গণতন্ত্র ইস্যুতে দুদেশের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক আরোপ অনেকের দৃষ্টিতে একটি 'সাঙ্কশন-সদৃশ' ব্যবস্থা, যা ব্যবসার মোড়কে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের এক কৌশল হতে পারে। যদিও হোয়াইট হাউস থেকে বলা হচ্ছে এটি বাণিজ্যনীতি সংশোধনের অংশ, তথাপি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের চোখে এটি একটি কূটনৈতিক বার্তা।

বাংলাদেশ সরকার অবশ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অধীনে গঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তাব দিয়েছে যে, বাংলাদেশ আমেরিকার থেকে আরও বেশি গম, তেল, এবং বোয়িং বিমানের যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারে, যাতে বাণিজ্য ভারসাম্য আনা যায়। সেই সঙ্গে দেশটি আবারো জোর দিয়ে জানায় যে তারা শ্রমিক অধিকার, কারখানার নিরাপত্তা এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে—যা যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (GSP) সুবিধা পুনর্বহালের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ।

তবে বাস্তবতা হলো, ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে GSP সুবিধা স্থগিত করে, এবং তা আজও পুনর্বহাল হয়নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে আগে থেকেই কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, নতুন করে এই ৩৫% শুল্ক সে সীমাবদ্ধতাকে ঘনীভূত করে তুলেছে।

অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ এই পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে দেখছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের টেক্সটাইল কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর মার্কিন ঘোষণার পরদিনই ৮% বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বাংলাদেশের পরিবর্তে ভারত, শ্রীলঙ্কা কিংবা মেক্সিকো থেকে পোশাক ক্রয়ের দিকে ঝুঁকবে। তাই এই শুল্ক শুধু বাংলাদেশের জন্য সংকট নয়, অন্যদের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা বলেন, হঠাৎ করে যেভাবে শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন মি. ট্রাম্প, সেটা আমাদের জন্য সত্যিই অপ্রত্যাশিত। কারণ, আমরা জানি, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আরএমজি (তৈরি পোশাক) ছাড়া অন্যান্য খাতের রপ্তানি এখনও খুবই সীমিত। কিন্তু প্রাণ গ্রুপসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছিল। আমরা আমাদের ফুড প্রোডাক্ট, মসলা, ফ্রোজেন ফুডস, কনফেকশনারি, জুস ও বেভারেজ রপ্তানি করি যুক্তরাষ্ট্রে।

প্রথমদিকে আমাদের রপ্তানি মূলত ছিল এশিয়ান কমিউনিটির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে এখন আমরা চেষ্টা করছি মূলধারার মার্কেটে প্রবেশ করতে। ‘ডলার ট্রি’র মতো স্টোর চেইনের মাধ্যমে বিভিন্ন মার্কিন শহরের মেইনস্ট্রিম মার্কেটে আমাদের পণ্য পৌঁছে দিচ্ছি। অনেক প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতির পর আমরা যখন সেই মার্কেটে একটু একটু করে প্রবেশ করছি, ঠিক তখনই এমন শুল্কবৃদ্ধির ঘোষণা এসেছে। এতে আমরা সত্যিই হোঁচট খেয়েছি। যদি এটি কার্যকর হয়, তাহলে আমাদের রপ্তানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।

আপনি জানেন, আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হয় ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনামসহ আরও অনেক দেশের সঙ্গে। যারা একই রকম পণ্য রপ্তানি করে এবং অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বিশেষ শুল্ক সুবিধা পায়। আবার যদি আমরা মূলধারার মার্কেটের কথা বলি, তাহলে ব্রাজিল, মেক্সিকোর মতো দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়, যাদের বাজারে প্রবেশ অনেক সহজ এবং শুল্ক হারও অনেক সহনীয়। সেক্ষেত্রে যদি সব দেশের জন্য একসাথে সমান হারে শুল্ক বাড়ানো হতো, তাহলে কথা ছিল এক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি থাকায় তারা তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে, আর আমরা পিছিয়ে পড়ব।

আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের প্রতিটি রপ্তানি কনসাইনমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রে FDA (Food and Drug Administration)–এর অনুমোদন ছাড়া বাজারজাত করা যায় না। এর জন্য ইউএস FDA থেকে পরিদর্শক এসে আমাদের কারখানার প্ল্যান্ট, প্রসেস এবং প্রডাকশন সিস্টেম ইন্সপেকশন করে যায়। তাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো পণ্য প্রবেশ করে না। প্রতিটি চালান তাদের ল্যাবে টেস্ট হয়, তারপরই বিক্রির অনুমতি মেলে। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আমাদের দেশে এক্রিডিটেড ল্যাব এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ফুড সেফটি ও সার্টিফিকেশন সিস্টেম থাকতে হয়।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে গেলে শুধু FDA–এর অনুমোদনই যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন মার্কেটের জন্য আমাদের BRC, BSCI, HACCP, Halal, Kosher, CT-PAT–এর মতো অনেক আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন দরকার। সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশে এসব সার্টিফিকেট ইস্যু করার পর্যাপ্ত সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। অনেকে বিদেশ থেকে কনসালটেন্ট এনে এসব সার্টিফিকেশন নিতে বাধ্য হয়, যা খরচ বাড়ায় এবং রপ্তানিকারকের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল করে।

উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমাদের বিএসটিআই হালাল সার্টিফিকেট দিলেও মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ বিএসটিআই এখনো সেসব দেশের স্বীকৃত হালাল অথরিটির সঙ্গে এক্রিডিটেড হয়নি। ফলে আবার তাদের প্রতিনিধি এনে সার্টিফিকেট নিতে হয়। এটি শুধু একটি উদাহরণ, এরকম বহু ছোট-বড় নন-ট্যারিফ বাধা রয়েছে, যা আমাদের সক্ষমতা সীমিত করে রাখে।

তবে আমরা আশাবাদী, সরকার যদি আমাদের কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পকে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের একটি মূল খাত হিসেবে বিবেচনা করে, এবং সেই অনুযায়ী প্রণোদনা, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস, এবং অবকাঠামো উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেয়, তাহলে প্রাণ গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু এশিয়ান মার্কেট নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার বাজারেও আরও শক্তিশালীভাবে অবস্থান করতে পারবে।

বিশেষ করে আমরা চাই উত্তরবঙ্গে একটি Agro-Processing স্পেশাল ইকোনমিক জোন হোক, যেখানে কৃষিপণ্য উৎপাদনের কাছাকাছি এলাকাতেই প্রক্রিয়াজাতকরণ হবে। এতে পণ্যের মান ভালো থাকবে, খরচ কমবে, এবং দ্রুত মার্কেটে পৌঁছানো সম্ভব হবে। সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের ফুড এক্সপোর্ট খাত বিশ্ববাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে পারবে।

তবে এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আশার আলো দেখছেন অনেকে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তকে 'চূড়ান্ত নয়' বলেছে এবং জানায়, আলোচনার ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত সংশোধন হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের পোশাক খাত এখনও আন্তর্জাতিক মানে প্রতিযোগিতামূলক—নিম্ন উৎপাদন খরচ, অভিজ্ঞ শ্রমশক্তি এবং দক্ষ সরবরাহ শৃঙ্খলা রয়েছে। সঠিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের সহায়তায় এই শুল্ক হ্রাস অথবা স্থগিত করানো সম্ভব।

বাংলাদেশকে এখন প্রয়োজন একটি সমন্বিত কৌশল। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্যান্য বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জাপান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং নতুন শিল্প খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাও জরুরি। একইসঙ্গে, দেশীয় উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য ও গুণগত মান উন্নত করা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ইরশাদ আহমেদ বলেন, আমাদের অনেক সময়ই মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে নিয়েই আগ্রহী। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার—এটি কেবল পোশাকশিল্পেই সীমাবদ্ধ নয়, সম্ভাবনার দিক থেকে কৃষিপণ্য, ওষুধ, হালকা প্রকৌশল পণ্য, আইসিটি সেবাসহ আরও অনেক খাত রয়েছে যেগুলো আমরা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারিনি।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একতরফাভাবে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যে ২৫–৩৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের যে আলোচনা চলছে, সেটি আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এই সিদ্ধান্ত যদি কার্যকর হয়, তাহলে আমাদের রপ্তানি কার্যক্রমে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। বিষয়টি শুধু বাণিজ্য সম্পর্ক নয়, বরং দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করতে পারে।

আমরা মনে করি, এ ধরনের বাণিজ্যিক নীতিমালা হঠাৎ পরিবর্তনের আগে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করছে, বিশেষত আইটি ও স্বাস্থ্যখাতে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের উচিত হবে বাংলাদেশের সঙ্গে ট্যারিফ–সংক্রান্ত আলোচনা ও রূপরেখা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা।

আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে একটি কার্যকর Preferential Trade Agreement (PTA) বা Free Trade Agreement (FTA) নিয়ে আলোচনা শুরু করা। আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে শুল্ক ছাড় দেয়। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে এখনো এ ধরনের কোনো কাঠামোগত বাণিজ্য চুক্তি হয়নি। ফলে আমাদের পণ্যের ওপর শুল্ক বেশি, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ি।

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর গড়ে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয়, যেটা ভিয়েতনাম, মেক্সিকোর মতো দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, খাদ্য ও কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে FDA ছাড়াও বিভিন্ন নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার অতিক্রম করতে হয়, যা তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ।

এ অবস্থায়, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন বাংলাদেশকে GSP বা অনুরূপ কোনো প্রেফারেন্সিয়াল সুবিধার আওতায় পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি, GSP সুবিধা ফিরে পেতে হলে শ্রম অধিকার, নিরাপত্তা, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে উন্নতি করতে হবে। কিন্তু আমরা ইতোমধ্যে বহু কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্পন্ন করেছি, বিশেষত তৈরি পোশাক খাতে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি বড় ভোক্তা বাজার হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এই বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের আরও বড় সুযোগ রয়েছে, বিশেষত কৃষি প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, ফুড প্রসেসিং, আইটি সার্ভিস, এবং টেলিকম খাতে।

AmCham-এর পক্ষ থেকে আমরা বারবার বলেছি, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক কেবল রপ্তানি ও আমদানিতে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। আমাদের প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ককে গভীরতর করা। আমরা চাই, উভয় দেশ মিলে একটি গঠনমূলক ও দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য কাঠামো তৈরি করুক, যার মাধ্যমে ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও স্বচ্ছ, স্থিতিশীল এবং সহনীয় হবে।

সবশেষে বলব, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক দূর এগিয়েছে। এখন সময় এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে আরও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আনতে। শুধু রাজনৈতিক স্তরে নয়, ব্যবসায়িকভাবে পারস্পরিক স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে আগাতে হবে। শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো দূর করা গেলে আমরা আরও বহুমুখী রপ্তানির সুযোগ পাব এবং একটি টেকসই বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে পারব।

যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫% শুল্ক বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর হুমকি, তবে এটি অপ্রতিরোধ্য নয়। সঠিক কৌশল, দৃঢ় কূটনৈতিক উদ্যোগ, এবং উৎপাদনখাতের দক্ষতা বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এ সংকটকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করা সম্ভব। এই পরিস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা যেমন বাস্তবতা, তেমনি কূটনীতি ও অর্থনৈতিক কৌশলও একটি দেশের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের সামনে এখন পরীক্ষার সময়, কিন্তু সংকল্প ও কৌশলের সমন্বয়ে এই পরীক্ষা সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

এনসিপির সমাবেশে হামলা অগ্রহণযোগ্য, দোষীদের বিচার হবে: সরকার

বিবৃতিতে সরকার বলছে, দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হবে। বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই।

১০ ঘণ্টা আগে

গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিতে হামলায় বিএনপির উদ্বেগ

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুষ্কৃতকারীরা আবারও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। আজ গোপালগঞ্জে এনসিপির পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির ওপর বর্বরোচিত হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইউএনওসহ আইনশৃঙ্খল

১১ ঘণ্টা আগে

'বাংলাদেশের মানুষ গোপালগঞ্জে ছুটে আসুন'

সারজিস বলেন, ‘গোপালগঞ্জে খুনি হাসিনার দালালরা আমাদের ওপরে আক্রমণ করেছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে নাটক দেখছে, পিছু হটছে। আমরা যদি এখান থেকে বেঁচে ফিরি তাহলে মুজিববাদের কবর রচনা করেই ফিরব, নাহয় ফিরব না। সারা বাংলাদেশের মানুষ গোপালগঞ্জে ছুটে আসুন।

১১ ঘণ্টা আগে

‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ স্লোগানে মঞ্চ কাঁপালেন হাসনাত

গোপালগঞ্জের পৌরপার্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশস্থলে হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলার পরপরই সেখানে উপস্থিত হন এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। মঞ্চে উঠেই দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ স্লোগানে সমাবেশস্থল উত্তাল হয়ে ওঠে।

১১ ঘণ্টা আগে