
বিশেষ প্রতিনিধি, রাজনীতি ডটকম

দীর্ঘ আলোচনা, নানা ইস্যুতে মতপার্থক্য। সবকিছু পেরিয়ে ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ প্রণীত হলো জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫। এরপর এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে জটিলতা। শুরু থেকেই সংস্কার প্রশ্নে সোচ্চার জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) চার বাম দল সে সনদে সই-ই করল না।
এর মধ্যেই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা হাজির করল ঐকমত্য কমিশন। তাতে আগের বিভেদ দূর হওয়ার বদলে আরও বাড়ল। একদিকে সনদের আইনি ভিত্তি, অন্যদিকে সনদ প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের তারিখ— নানা মতে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টেই বল ঠেলে দিলো সরকার। তার জন্য ‘বেঁধে দেওয়া’ সময় শেষ হলেও রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনাতেই বসতে পারেনি।
এদিকে জুলাই সনদের গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগেই আয়োজনসহ পাঁচ দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল। এ দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি। অন্যদিকে বিএনপিসহ সমমনারাও জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনের বিষয়ে অনড়। এ অবস্থায় জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ কী, জুলাই সনদ ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে কি জাতীয় নির্বাচন নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দেবে— এসব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বেশকিছু সংস্কার প্রস্তাব উঠে আসে, যেগুলোকে বলা হচ্ছে মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব। মূল জুলাই সনদে মোট ৮৪টি প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, তবে ভিন্নমত তথা নোট অব ডিসেন্টসহ। সেসব নোট অব ডিসেন্টসহই পাঁচটি রাজনৈতিক দল বাদে বাকি ২৫টি দল সনদে সই করেছে।
তখন পর্যন্ত সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা স্পষ্ট ছিল না। সনদ সইয়ের দিন দশেক পর ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেয়। গোলমালটা বাঁধে সেখানেই। বিএনপি সুস্পষ্টভাবে অভিযোগ তোলে, সনদ যেভাবে সই হয়েছিল একই রূপ রাখা হয়নি বাস্তবায়নের সুপারিশে। বিশেষ করে জুলাই সনদের প্রস্তাবনায় বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট এই সুপারিশে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির দ্বিতীয় অভিযোগ, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রথম ধাপে সরকারের আদেশ ও দ্বিতীয় ধাপে গণভোটের রায়ের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের সুপারিশ করেছে ঐকমত্য কমিশন, যে বিষয়ে কমিশনের আট মাসের ৭৪ বৈঠকে কোনো আলোচনাই হয়নি।
তাছাড়া কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, গণভোটে প্রস্তাবগুলো পাস হলে আগামী সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এর মধ্যে পরিষদ সনদ বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হলে ২৭০ দিন পর গণভোটে পাস হওয়া সনদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তবায়ন হয়ে যাবে, অর্থাৎ সংস্কার প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধানের বিভিন্ন ধারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যাবে। এ প্রস্তাবেরও তীব্র বিরোধিতা করেছে বিএনপি।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদের আরেকটি ইস্যু জুলাই সনদের গণভোট। বিএনপির স্পষ্ট দাবি, ফেব্রুয়ারিতে সরকার জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, সেই নির্বাচনের দিনেই এই গণভোট হতে হবে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে মাত্র তিন মাসের মধ্যে একটি গণভোট আয়োজনের সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। আর এই সময়ের মধ্যে গণভোট আয়োজনের সক্ষমতা থাকলে জাতীয় নির্বাচনও একই দিনে আয়োজন করা সম্ভব। ফলে আলাদা করে জুলাই সনদের গণভোট আয়োজনের দাবি বাস্তবসম্মত নয়।
এ অভিমতের বিপরীতে দাঁড়ানো জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর বক্তব্য, জাতীয় নির্বাচনের আগেই হতে হবে জুলাই সনদের গণভোট। কারণ সনদে এমন কিছু প্রস্তাব রয়েছে যেগুলো পাস হলে সংসদ নির্বাচনের ধরনও পালটে যাবে। জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট হলে সনদ অনুযায়ী সেই নির্বাচন হওয়া সম্ভব না।
জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যখন বিপরীত মেরুতে তখন ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের কেউই এখন পর্যন্ত এ সংকট নিরসনের সুস্পষ্ট দায়িত্ব নেয়নি। ঐকমত্য কমিশন তাদের সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে গণভোট আয়োজনের কোনো তারিখ দেয়নি। তাদের প্রস্তাব, জাতীয় নির্বাচনের দিন কিংবা এর আগের যেকোনো দিনেই এই গণভোট হতে পারে। সরকার এ দিনতারিখ নির্ধারণ করবে।
তবে দিনতারিখ নির্ধারণের দিকে যায়নি সরকারও। গত ৩ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সবার ধারণা ছিল, সেই বৈঠক থেকেই উঠে আসবে গণভোটের তারিখ বা সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। হয়েছে উলটোটা।
ওই বৈঠক শেষে সরকারের পক্ষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ব্রিফিং করে বলেন, সরকার চাইছে রাজনৈতিক দলগুলোই যেন নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান সরকারকে জানায়। সরকার সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে। আলটিমেটাম না দিলেও সাত দিনের মধ্যে দলগুলো এই ঐক্যবদ্ধ অভিমত সরকারকে জানালে ভালো হবে— এমনটিই বলেন আইন উপদেষ্টা।
সরকারের এ আহ্বানের পর দিন গড়িয়ে যেতে থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনায় বসার কোনো ইঙ্গিত দেখা যায়নি। সরকারের ব্রিফিংয়ের চার দিন পর অবশ্য জামায়াতে ইসলামী জানায়, তারা বিএনপিকে আলোচনার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। সে আহ্বানে সাড়া মেলেনি বিএনপির পক্ষ থেকে। অন্যদিকে ছয় রাজনৈতিক দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চও আলোচনার একটি উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বলে জানা গেছে।
রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, বিএনপি মহাসচিবকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ওনারা বলেছেন, জামায়াতের আহ্বানে তারা সাড়া দেবেন না। তবে বিএনপি যদি আহ্বান করে, জামায়াত আলোচনায় যাবে এবং অন্যদেরও আলোচনায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ার চেষ্টার কথা জানিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক অনুষ্ঠানে বলেন, আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু তা খুব একটা অগ্রসর হয়নি। বিএনপি আলোচনার বিপক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, আর জামায়াত দ্বৈত চরিত্র দেখিয়ে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে। সামগ্রিকভাবে এখনো কোনো ঐক্যের পথ তৈরি হয়নি।
বিএনপি কেন এই আলোচনায় যাচ্ছে না— সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। কাকরাইলে ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের আলোচনার আহ্বান ইস্যুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার বা প্রধান উপদেষ্টা যদি আমাদের আহ্বান জানান কোনো বিষয়ে আলোচনা করার জন্য, আমরা সবসময় আলোচনায় আগ্রহী, যাব। কিন্তু অন্য কোনো একটি রাজনৈতিক দল দিয়ে আমাদের আহ্বান জানানো হচ্ছে কেন?
জুলাই সনদ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সরকারের সমালোচনা করে বিএনপির এই নেতা বলেন, আপনারা কোনো নির্বাচিত সরকার নন, এটা আপনারা যেন সবসময় ইয়াদ (মনে) রাখেন— আপনাদের এ রকম কোনো এখতিয়ার নাই যে আমাদের ডিকটেট (আদেশ) করবেন— সাত দিনের ভেতরে আপনারা সিদ্ধান্ত না হলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। এত শক্তি প্রদর্শন আপনাদের বোধহয় মানায় না।
‘বিএনপি সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, সেটা এনসিপি হোক, জামায়াত হোক বা অন্যান্য পার্টি। গণতান্ত্রিক কালচার (সংস্কৃতি) হিসেবে সবার সঙ্গে আমরা রাজনৈতিক যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনার সম্পর্ক রাখব। কিন্তু কোনো বিষয়ে আলোচনা করার জন্য কোনো রেফারির ভূমিকায় কোনো দলকে দিয়ে আপনারা আহ্বান জানাবেন ইনডিরেক্টলি, সেটা বোধহয় সঠিক হচ্ছে না,’— বলেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
এ পরিস্থিতির জন্য সরকারকেই দায়ী করছে জামায়াতে ইসলামীও। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সংকটের দায়ভার সরকারের। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিজেই সংকটের পথ তৈরি করেছে। দলগুলোই যদি সমাধান করতে পারে, তাহলে কমিশন কেন হলো? কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দায়িত্ব সরকারের। সেটা দলগুলোর দিকে ঠেলে দেওয়া হলো।
একই সমালোচনা করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হকও। তিনি বলেন, সরকার যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে বল তুলে দিয়েছে, আমি মনে করি সেটি খুব অন্যায় কাজ করেছে। আসলে এই সংকটটা ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের তৈরি করা। কারণ তারা দলগুলোর অবস্থান জানে। সব দল যেখানে ঐকমত্য পোষণ করেছে, সেখানেই দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল। যেসব প্রশ্নে ঐকমত্য হয়নি, সেসব কোনোভাবেই সবার সিদ্ধান্ত হিসেবে চাপানো উচিত হয়নি।
জুলাই সনদ নিয়ে এমন অচলাবস্থার মধ্যেই মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) রাজধানীর পল্টন মোড়ে যৌথ সমাবেশ কর্মসূচি রয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দলের। বাকি দলগুলো হলো— ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), নেজামে ইসলাম পার্টি, ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।
দলগুলোর অনড় অবস্থানের পাশাপাশি রাজপথের কর্মসূচির মুখে সরকারকেই সংকটের সমাধান বের করার আহ্বান জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া মন্তব্যে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতিকে বলেছিলেন, যে দল যেটুকু মানবে সেটুকু বাস্তবায়িত হবে। বাকিটা তিনি ওয়েবসাইটে দিয়ে জাতিকে জানাবেন। এখন দলগুলো যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে সেটুকু বাস্তবায়নের দায়িত্ব তো সরকারের। যারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে সেগুলো সুপারিশে না থাকাতেই এই সংকট তৈরি হয়েছে। সে কারণে এটি সমাধানের দায় কমিশন ও সরকারের।

দীর্ঘ আলোচনা, নানা ইস্যুতে মতপার্থক্য। সবকিছু পেরিয়ে ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ প্রণীত হলো জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫। এরপর এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে জটিলতা। শুরু থেকেই সংস্কার প্রশ্নে সোচ্চার জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) চার বাম দল সে সনদে সই-ই করল না।
এর মধ্যেই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা হাজির করল ঐকমত্য কমিশন। তাতে আগের বিভেদ দূর হওয়ার বদলে আরও বাড়ল। একদিকে সনদের আইনি ভিত্তি, অন্যদিকে সনদ প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের তারিখ— নানা মতে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টেই বল ঠেলে দিলো সরকার। তার জন্য ‘বেঁধে দেওয়া’ সময় শেষ হলেও রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনাতেই বসতে পারেনি।
এদিকে জুলাই সনদের গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগেই আয়োজনসহ পাঁচ দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল। এ দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি। অন্যদিকে বিএনপিসহ সমমনারাও জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনের বিষয়ে অনড়। এ অবস্থায় জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ কী, জুলাই সনদ ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে কি জাতীয় নির্বাচন নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দেবে— এসব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বেশকিছু সংস্কার প্রস্তাব উঠে আসে, যেগুলোকে বলা হচ্ছে মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব। মূল জুলাই সনদে মোট ৮৪টি প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, তবে ভিন্নমত তথা নোট অব ডিসেন্টসহ। সেসব নোট অব ডিসেন্টসহই পাঁচটি রাজনৈতিক দল বাদে বাকি ২৫টি দল সনদে সই করেছে।
তখন পর্যন্ত সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা স্পষ্ট ছিল না। সনদ সইয়ের দিন দশেক পর ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেয়। গোলমালটা বাঁধে সেখানেই। বিএনপি সুস্পষ্টভাবে অভিযোগ তোলে, সনদ যেভাবে সই হয়েছিল একই রূপ রাখা হয়নি বাস্তবায়নের সুপারিশে। বিশেষ করে জুলাই সনদের প্রস্তাবনায় বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট এই সুপারিশে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির দ্বিতীয় অভিযোগ, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রথম ধাপে সরকারের আদেশ ও দ্বিতীয় ধাপে গণভোটের রায়ের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের সুপারিশ করেছে ঐকমত্য কমিশন, যে বিষয়ে কমিশনের আট মাসের ৭৪ বৈঠকে কোনো আলোচনাই হয়নি।
তাছাড়া কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, গণভোটে প্রস্তাবগুলো পাস হলে আগামী সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এর মধ্যে পরিষদ সনদ বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হলে ২৭০ দিন পর গণভোটে পাস হওয়া সনদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তবায়ন হয়ে যাবে, অর্থাৎ সংস্কার প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধানের বিভিন্ন ধারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যাবে। এ প্রস্তাবেরও তীব্র বিরোধিতা করেছে বিএনপি।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদের আরেকটি ইস্যু জুলাই সনদের গণভোট। বিএনপির স্পষ্ট দাবি, ফেব্রুয়ারিতে সরকার জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, সেই নির্বাচনের দিনেই এই গণভোট হতে হবে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে মাত্র তিন মাসের মধ্যে একটি গণভোট আয়োজনের সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। আর এই সময়ের মধ্যে গণভোট আয়োজনের সক্ষমতা থাকলে জাতীয় নির্বাচনও একই দিনে আয়োজন করা সম্ভব। ফলে আলাদা করে জুলাই সনদের গণভোট আয়োজনের দাবি বাস্তবসম্মত নয়।
এ অভিমতের বিপরীতে দাঁড়ানো জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর বক্তব্য, জাতীয় নির্বাচনের আগেই হতে হবে জুলাই সনদের গণভোট। কারণ সনদে এমন কিছু প্রস্তাব রয়েছে যেগুলো পাস হলে সংসদ নির্বাচনের ধরনও পালটে যাবে। জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট হলে সনদ অনুযায়ী সেই নির্বাচন হওয়া সম্ভব না।
জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যখন বিপরীত মেরুতে তখন ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের কেউই এখন পর্যন্ত এ সংকট নিরসনের সুস্পষ্ট দায়িত্ব নেয়নি। ঐকমত্য কমিশন তাদের সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে গণভোট আয়োজনের কোনো তারিখ দেয়নি। তাদের প্রস্তাব, জাতীয় নির্বাচনের দিন কিংবা এর আগের যেকোনো দিনেই এই গণভোট হতে পারে। সরকার এ দিনতারিখ নির্ধারণ করবে।
তবে দিনতারিখ নির্ধারণের দিকে যায়নি সরকারও। গত ৩ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সবার ধারণা ছিল, সেই বৈঠক থেকেই উঠে আসবে গণভোটের তারিখ বা সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। হয়েছে উলটোটা।
ওই বৈঠক শেষে সরকারের পক্ষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ব্রিফিং করে বলেন, সরকার চাইছে রাজনৈতিক দলগুলোই যেন নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান সরকারকে জানায়। সরকার সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে। আলটিমেটাম না দিলেও সাত দিনের মধ্যে দলগুলো এই ঐক্যবদ্ধ অভিমত সরকারকে জানালে ভালো হবে— এমনটিই বলেন আইন উপদেষ্টা।
সরকারের এ আহ্বানের পর দিন গড়িয়ে যেতে থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনায় বসার কোনো ইঙ্গিত দেখা যায়নি। সরকারের ব্রিফিংয়ের চার দিন পর অবশ্য জামায়াতে ইসলামী জানায়, তারা বিএনপিকে আলোচনার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। সে আহ্বানে সাড়া মেলেনি বিএনপির পক্ষ থেকে। অন্যদিকে ছয় রাজনৈতিক দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চও আলোচনার একটি উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বলে জানা গেছে।
রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, বিএনপি মহাসচিবকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ওনারা বলেছেন, জামায়াতের আহ্বানে তারা সাড়া দেবেন না। তবে বিএনপি যদি আহ্বান করে, জামায়াত আলোচনায় যাবে এবং অন্যদেরও আলোচনায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ার চেষ্টার কথা জানিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক অনুষ্ঠানে বলেন, আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু তা খুব একটা অগ্রসর হয়নি। বিএনপি আলোচনার বিপক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, আর জামায়াত দ্বৈত চরিত্র দেখিয়ে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে। সামগ্রিকভাবে এখনো কোনো ঐক্যের পথ তৈরি হয়নি।
বিএনপি কেন এই আলোচনায় যাচ্ছে না— সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। কাকরাইলে ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের আলোচনার আহ্বান ইস্যুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার বা প্রধান উপদেষ্টা যদি আমাদের আহ্বান জানান কোনো বিষয়ে আলোচনা করার জন্য, আমরা সবসময় আলোচনায় আগ্রহী, যাব। কিন্তু অন্য কোনো একটি রাজনৈতিক দল দিয়ে আমাদের আহ্বান জানানো হচ্ছে কেন?
জুলাই সনদ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সরকারের সমালোচনা করে বিএনপির এই নেতা বলেন, আপনারা কোনো নির্বাচিত সরকার নন, এটা আপনারা যেন সবসময় ইয়াদ (মনে) রাখেন— আপনাদের এ রকম কোনো এখতিয়ার নাই যে আমাদের ডিকটেট (আদেশ) করবেন— সাত দিনের ভেতরে আপনারা সিদ্ধান্ত না হলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। এত শক্তি প্রদর্শন আপনাদের বোধহয় মানায় না।
‘বিএনপি সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, সেটা এনসিপি হোক, জামায়াত হোক বা অন্যান্য পার্টি। গণতান্ত্রিক কালচার (সংস্কৃতি) হিসেবে সবার সঙ্গে আমরা রাজনৈতিক যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনার সম্পর্ক রাখব। কিন্তু কোনো বিষয়ে আলোচনা করার জন্য কোনো রেফারির ভূমিকায় কোনো দলকে দিয়ে আপনারা আহ্বান জানাবেন ইনডিরেক্টলি, সেটা বোধহয় সঠিক হচ্ছে না,’— বলেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
এ পরিস্থিতির জন্য সরকারকেই দায়ী করছে জামায়াতে ইসলামীও। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সংকটের দায়ভার সরকারের। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিজেই সংকটের পথ তৈরি করেছে। দলগুলোই যদি সমাধান করতে পারে, তাহলে কমিশন কেন হলো? কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দায়িত্ব সরকারের। সেটা দলগুলোর দিকে ঠেলে দেওয়া হলো।
একই সমালোচনা করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হকও। তিনি বলেন, সরকার যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে বল তুলে দিয়েছে, আমি মনে করি সেটি খুব অন্যায় কাজ করেছে। আসলে এই সংকটটা ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের তৈরি করা। কারণ তারা দলগুলোর অবস্থান জানে। সব দল যেখানে ঐকমত্য পোষণ করেছে, সেখানেই দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল। যেসব প্রশ্নে ঐকমত্য হয়নি, সেসব কোনোভাবেই সবার সিদ্ধান্ত হিসেবে চাপানো উচিত হয়নি।
জুলাই সনদ নিয়ে এমন অচলাবস্থার মধ্যেই মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) রাজধানীর পল্টন মোড়ে যৌথ সমাবেশ কর্মসূচি রয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দলের। বাকি দলগুলো হলো— ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), নেজামে ইসলাম পার্টি, ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।
দলগুলোর অনড় অবস্থানের পাশাপাশি রাজপথের কর্মসূচির মুখে সরকারকেই সংকটের সমাধান বের করার আহ্বান জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া মন্তব্যে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতিকে বলেছিলেন, যে দল যেটুকু মানবে সেটুকু বাস্তবায়িত হবে। বাকিটা তিনি ওয়েবসাইটে দিয়ে জাতিকে জানাবেন। এখন দলগুলো যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে সেটুকু বাস্তবায়নের দায়িত্ব তো সরকারের। যারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে সেগুলো সুপারিশে না থাকাতেই এই সংকট তৈরি হয়েছে। সে কারণে এটি সমাধানের দায় কমিশন ও সরকারের।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধনের দাবিতে অনশন করছেন আমজনতার দলের সদস্য সচিব মো. তারেক রহমান। আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সামনে তার অনশন পেরিয়ে গেছে ১২৫ ঘণ্টা, তথা টানা পাঁচ দিন। তার শারীরিক অবস্থারও অবনতি ঘটেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলছে, ৫০০ ঘণ্টা অনশন করলেও তাদের কিছু করার নেই।
১৬ ঘণ্টা আগে
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘এখন নিশ্চিতভাবেই বলছি, আমি নির্বাচন করব।’ পদত্যাগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কবে নাগাদ পদত্যাগ করব, এটা এখনো ঠিক হয়নি। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করে সেই সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।’
১৭ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি গুঞ্জন উঠছে, বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা হলে সরকার থেকে পদত্যাগ করে ঢাকা-১০ আসনে নির্বাচন করতে পারেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। এখন আসিফ মাহমুদের এই আসনের ভোটার হতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে গুঞ্জনটি আরও পাকাপোক্ত হচ্ছে।
২০ ঘণ্টা আগে
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো এখনো পুরনো ক্ষমতাকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়িত না হলে তরুণদের ‘ক্রিমিনালাইজেশন’ কেবল বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা আদালত পর্যন্ত গড়াব
১ দিন আগে