সংবিধান নিয়ে কী থাকবে জুলাই ঘোষণাপত্রে

বিবিসি বাংলা
গত ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচি আহ্বান করেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরে সরকার ঘোষণাপত্র প্রণয়নের ঘোষণা দিলে সে দিন শুধু সমাবেশ করে ছাত্রদের সংগঠনটি। ফাইল ছবি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে গত ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের কথা ছিল। সমন্বয়করা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ওই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ‘বাহাত্তরের মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচনা হবে’। পরে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ওই ঘোষণাপত্র সরকারই প্রণয়ন করবে জানালে সে দিন সমাবেশে সীমাবদ্ধ ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি।

সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, তারা ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এর মধ্যেই ছাত্রদের পক্ষ থেকে এই ঘোষণাপত্রের জন্য সাত দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে। সেই দাবির মধ্যে রয়েছে নতুন সংবিধানের অঙ্গীকারও।

জুলাই ঘোষণাপত্রে সংবিধানের বিষয়টি কী হবে এবং আন্দোলনকারীরা কী চাইছেন, তা নিয়েই এখন চলছে নানা আলোচনা। প্রশ্ন উঠেছে— ঘোষণাপত্রে সংবিধান নিয়ে কী ভাবনা রয়েছে।

ঘোষণাপত্র সংবিধান প্রসঙ্গে কী থাকছে, এ নিয়ে জানতে বিবিসি কথা বলেছে অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের সঙ্গে।

সংবিধান নিয়ে যা বলছেন ছাত্ররা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি দেশব্যাপী ঘোষণাপত্র সপ্তাহ পালন করছে। বিভিন্ন জায়গায় জনসভা, গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করছে। লিফলেটে সাত দফা দাবির উল্লেখ রয়েছে, যেগুলো জুলাই ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হচ্ছে।

ওই সাত দফার মধ্যে পঞ্চম দাবিতে বলা হয়েছে ‘ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি সংবিধান বাতিল করে নির্বাচিত গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে।’

জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা চাই প্রক্লেমেশনকে সংবিধানের সঙ্গে অ্যাকোমোডেট করা হবে এবং এই গণঅভ্যুত্থানের স্বীকৃতি থাকবে। সংবিধানকে রদ করতে হবে, এমন না। সংবিধানের দোহাই দিয়েই কিন্তু ফ্যাসিবাদ দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শাসন করে গেছে। তাই আমাদের চাওয়া— যে বিষয়গুলো আমাদের বাকস্বাধীনতা, ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে বাধা অর্থাৎ যে বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক নয়, সেগুলো সংবিধানে থাকবে না।

‘আমরা প্রাথমিক একটি খসড়া করেছিলাম। অন্য কেউ যেহেতু উদ্যোগ নেয়নি তাই আমাদের উদ্যোগটি নিতে হয়েছিল। মতপার্থক্যের যে জায়গাগুলো, আমরা মনে করি সেগুলো আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। আর যেখানে মতৈক্য রয়েছে সেগুলো হচ্ছে আমাদের শক্তিমত্তার জায়গা,’— বলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।

জুলাই ঘোষণাপত্রের কর্মসূচি দেওয়ার সময় জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছিলেন, ৩১ ডিসেম্বর ঘোষণাপত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার ‘বাহাত্তরের মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচনা হবে’। সেই ঘোষণাপত্র প্রকাশের সুযোগ তারা পাননি। এখন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে।

ঘোষণাপত্র ও সংবিধান নিয়ে সারজিস আলম বলেন, ‘প্রক্লেমেশনটি সংবিধানের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় থাকবে। একাত্তরের ইতিহাসকে সংবিধান যেমন ধারণ করে, চব্বিশের ইতিহাসকেও একটি অংশে ধারণ করবে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে বলেছি, এই সংবিধান মুজিববাদী সংবিধান। এই সংবিধানের আমরা অনেক জায়গা থেকে, মাঠ পর্যায় থেকে শুনছি এর পরিবর্তন প্রয়োজন। বড় একটি অংশের সংস্কার প্রয়োজন। আমরা আমাদের জায়গা থেকে মনে করি, আমরা মাঠ থেকে যে তথ্য পাব সেটি রিপ্রেজেন্ট করব।’

31st-December-July-Proclamation-Program-At-Shahid-Minar-(2)

নানা পক্ষের বিরোধিতা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলের আপত্তি তো ছিলই, পাশাপাশি তারুণ্যনির্ভর আরেকটি দল গণঅধিকার পরিষদও এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছিল।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর জানান, ফ্যাসিবাদবিরোধী সবার মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র আসলে স্বাগত জানাবেন তারা। তিনি বলেন, ‘খসড়ার কিছু বিষয়, যেমন— নিউ রিপাবলিক, নিউ রিপাবলিক হলে তো বিদ্যমান সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামো কিছুই থাকে না। তখন তো দেশে নৈরাজ্য তৈরি হবে। এই মুহূর্তে এটা আমরা কেউই চাই না।’

নুর বলেন, ‘সেখানে শুধু আন্দোলনকেন্দ্রিক কিছু কথা ছিল। রাষ্ট্র পুনর্গঠনে বা সংস্কার বিষয়ে খুব বেশি স্পষ্ট কিছু ছিল না। কিছু কথা, যেগুলো মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলোর সঙ্গেও আমরা একমত না।’

সরকার কীভাবে ভাবছে

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বিবিসিকে জানান, সবার মতামতের ভিত্তিতেই ঘোষণাপত্র তৈরি করা হবে। তবে এটি হবে একটি রাজনৈতিক দলিল। এই ঘোষণাপত্রের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে না।

মাহফুজ বলেন, ‘ছাত্ররা এক ধরনের প্রস্তাবনা দিচ্ছে। আবার বিএনপি নেতাদের বা বিভিন্ন পক্ষ থেকে শুনতে পাচ্ছি সংবিধানের বিষয়ে। তবে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, কনসালটেশনের ভিত্তিতে এটা গৃহীত হবে। আমরা মনে করি, এটা ওয়াইডার কনসালটেশনের ভিত্তিতে গৃহীত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য। স্থিতিশীলতারও প্রশ্ন।’

মাহফুজ আলম বলছেন, সরকার মনে করে ঘোষণাপত্রে সংবিধান ইস্যুটি সবার সম্মতির ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়। তবে ছাত্রদের দৃষ্টিভঙ্গিকে ফেলনা হিসেবেও দেখে না সরকার। তিনি বলেন, পক্ষে-বিপক্ষে সব মতামত আমরা শুনব। শুনে যেখানটায় আমরা ঐকমত্য তৈরি করতে পারব বলে মনে হবে, সেটাই আমরা লিখব।

ঘোষণাপত্রে বাহাত্তরের সংবিধান স্থগিত করার কিছু থাকবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, ‘সংবিধান বাতিলের প্রশ্ন এখানে আসছে না। সংবিধান স্থগিত হওয়ার যে প্রক্রিয়া, সেটি লিগ্যাল একটি ডকুমেন্ট। আর এটাকে আমরা বলছি পলিটিক্যাল ডকুমেন্ট। কোনো আইনি বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর এর আইনি প্রভাব থাকবে না। এর আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে না, কিন্তু নৈতিক অবস্থান থাকবে। এবং যেটা আমাদের মধ্যে আলোচনা আছে, সরকার এই ঘোষণাপত্রের সূত্র ধরে একটি লিগ্যাল ডকুমেন্ট রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রস্তুত করবে।’

আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবি রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জানান, এর জন্য অংশীজন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। তবে সেটি ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সম্ভবত চূড়ান্ত করা যাবে না। আবার খুব বেশি দেরিও হবে না।

বর্তমান বাস্তবতায় সংবিধানের মতো মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তনের বিষয়ে ঐকমত্য হওয়াটা কঠিন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ৫ অগাস্টের আগে। সংবিধান, নির্বাচন, সংস্কারের মতো মৌলিক বিষয়ে প্রত্যেক দলের ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থ রয়েছে। যে কারণে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো ধরনের বিপ্লবী ঘোষণাপত্র দেওয়াটা এখন কঠিন।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

মামলা থেকে মির্জা আব্বাস দম্পতিকে অব্যাহতি

৪ ঘণ্টা আগে

বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ক্ষুব্ধ সারজিস, বললেন কলিজা ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে রাখব

সারজিস আলম বলেন, এক দিন হইত, দুই দিন হইত কিচ্ছু বলতাম না। তিন দিনের তিন দিনই এটা হইছে। যারা এটা করছে, তারা হচ্ছে রাজনৈতিক... (প্রকাশ অযোগ্য শব্দ)। এই রাজনৈতিক দেউলিয়াদের আমরা দেখে নেব তাদের কলিজা কত বড় হইছে। কলিজা ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে রাখব।

২০ ঘণ্টা আগে

৫ দাবিতে ৩য় দফায় কর্মসূচি ঘোষণা জামায়াতের

নতুন ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামী মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) মানববন্ধন হবে ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগীয় শহরে। পরদিন বুধবার (১৫ অক্টোবর) একই কর্মসূচি পালন করা হবে দেশের সব জেলা সদরে।

২১ ঘণ্টা আগে

পিআর পদ্ধতি দেশের মানুষ গ্রহণ করবে না: মির্জা ফখরুল

১ দিন আগে