দুর্নীতি

এ কালের ফার্দিনান্ড- ইমেলদা

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৫, ১৮: ৩৭
বেনজির ও ইমেলদা মার্কোস। এআই ব্যবহার করে তৈরি।

আশির দশকে ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক ফার্দিনান্ড মার্কোস ও তার স্ত্রী ইমেলদা মার্কোস ছিলেন ক্ষমতা ও দুর্নীতির এক যুগল প্রতিমূর্তি। ইমেলদার সংগ্রহে থাকা ৩,০০০ জোড়া জুতা ও বিলাসবহুল জীবনযাপন বহুদিন ধরেই বিশ্ব মিডিয়ার আলোচনায় ছিল। ২০২০ দশকের বাংলাদেশে তারই সমসাময়িক প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবার—অন্তত দুদকের জব্দ তালিকা ও নিলাম কমিটির পর্যবেক্ষণ তা-ই বলছে।

ঢাকার অভিজাত এলাকায় গুলশানের র‍্যাঙ্কন টাওয়ারের চারটি আলাদা ফ্ল্যাট একত্র করে বেনজীর দম্পতি তৈরি করেন এক বিশাল ডুপ্লেক্স ইউনিট, যেখানে রয়েছে সুইমিং পুল, মিনি থিয়েটার, গেস্ট লাউঞ্জ, ১৯টি ফ্রিজ, এবং ১০০ টনের সমতুল্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে সাজানো রয়েছে এমন সব সামগ্রী, যা বিত্তবান মানুষের জীবনধারাকেও ছাপিয়ে যায়।

বেনজীর আহমেদের গুলশানের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে থাকা তাঁর পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিলামে তোলা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত নিলাম কমিটি গঠন করে দিয়েছেন।

কয়েক দিনের মধ্যে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিলামে তোলার ব্যবস্থা করা হবে বলে সোমবার কমিটির এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। কমিটি নিলাম প্রক্রিয়ার মানদণ্ড ঠিক করেছে এবং নিলাম প্রক্রিয়া আয়োজনের ব্যবস্থা নিয়েছে।

ইতিমধ্যে সম্পদের জব্দ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকায় সম্পদবিবরণী তৈরি করতে গিয়ে নিলাম কমিটির সদস্যরা অবাক হয়েছেন। তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারেননি, একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মহোৎসব করবেন।

দুদক ও আদালতের নিলাম কমিটির সদস্যরা এই ফ্ল্যাট থেকে সংগ্রহ করেছেন ২৪৬টি আইটেম, যার কিছু কিছু পরিমাণ শুনলে ইমেলদা মার্কোসও হয়তো ঈর্ষান্বিত হতেন। উদাহরণস্বরূপ:

  • পুরুষদের শার্ট ১২২টি, প্যান্ট ২৬৬টি, টি-শার্ট ৭২২টি, ব্লেজার ৩০টি, স্যুট ৮টি
  • নারীদের শাড়ি ৪৯৪টি, থ্রিপিস ২৫০ সেট, সালোয়ার-কামিজ ৪৯৬টি, লেহেঙ্গা ১৬টি, ভ্যানিটি ব্যাগ ৭৫টি, লেডিস টপস ৬২২টি
  • জুতা ও স্যান্ডেলের সংখ্যা ১৬১ জোড়া
  • নাইট ড্রেস ৫৮টি, শাল-চাদর ৮৯টি, শীতের জামা ১৩২টি, ওড়না ৩৪৭টি

এই পরিমাণ কাপড়-চোপড়, গয়না, সৌন্দর্য সামগ্রী ও ইলেকট্রনিকস দেখে কমিটির এক সদস্য বিস্মিত হয়ে বলেন, “মনে হচ্ছিল যেন ইমেলদা মার্কোসের মালপত্রের তালিকা করছি।”

২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পুলিশের সর্বোচ্চ পদে থাকা বেনজীর আহমেদকে আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন। এর আগে তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার এবং র‍্যাবের মহাপরিচালক। গুম-খুনের অভিযোগ, বিরোধীদলের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগসহ নানা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০২৪ সালের ৪ মে, যখন দেশজুড়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা তুঙ্গে, তখন বেনজীর ও তার পরিবার নতুন পাসপোর্ট বানিয়ে গোপনে দেশ ত্যাগ করেন।

দুদক তাদের তদন্তে জানিয়েছে, দেশ ছাড়ার সময় তারা সঙ্গে করে বহন করেন ব্যাগভর্তি স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে মামলা হয়েছে।

শুধু বেনজীর নন—তার স্ত্রী ও দুই কন্যার বিরুদ্ধেও রয়েছে বিশাল অঙ্কের অভিযোগ।

  • স্ত্রী জীশান মীর্জা: ৩১.৬৯ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন, ১৬ কোটি টাকার তথ্য গোপন
  • বড় মেয়ে ফারহীন: ৮.৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ
  • ছোট মেয়ে তাহসীন: ৫.৫৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ

সবমিলিয়ে এই পরিবারের বিরুদ্ধে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ ও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

একটি ঐতিহাসিক মিল

ইমেলদা মার্কোস ফিলিপাইনের সাবেক ফার্স্ট লেডি। দেশটির নির্বাসিত স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের স্ত্রী তিনি। তবে ফ্যাশন সচেতনতা, অভিজাত ও বিলাসী জীবনযাপনের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। তবে জীবনভর বিতর্ক পিছু ছাড়েনি ইমেলদার। কখনো সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ, কখনো বিলাসী জীবনের জন্য তিনি খবরের শিরোনাম হয়েছেন।

১৯৮৬ সালে যখন বিক্ষোভকারীরা ম্যানিলায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে পড়েন, তখন সেখানে ছিলেন মার্কিন সাংবাদিক জিম লরি। তাঁর ভাষ‍্য, ইমেলদার সাজঘরে গিয়ে দেখা গেল সেখানে শত শত ডিজাইনের গাউন রয়েছে। নিউইয়র্ক, প্যারিস, রোমের নামকরা বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ডের লেবেল তখনো ছেঁড়া হয়নি। তিনি হয়তো সেগুলোর অধিকাংশ একবারও পরেননি। পাশেই রয়েছে ইমেলদার দামি দামি জুতার বিশাল সংগ্রহ। সংখ্যায় তা তিন সহস্রাধিক।

সাংবাদিক জিম লরি আরও বলেন, ফিলিপাইন গরিব দেশ। এই বিলাসিতা দৃষ্টিকটু। তবে ফার্স্ট লেডি ইমেলদার জুতা-জামা-গয়নার পেছনে এমন ব্যয়ের নজির মার্কোসের শাসনামলের দুর্নীতির ব্যাপকতার একটি ক্ষুদ্র প্রমাণ মাত্র। এই পরিবার কোটি কোটি ডলার বিদেশে পাচার করেছে। পশ্চিমা বিশ্বে বিনিয়োগ করেছে।

যেমন ইমেলদা মার্কোস তার স্বামীর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে ব্যক্তিগত ভাণ্ডারে রূপান্তর করেছিলেন, তেমনি বেনজীরও তার পদমর্যাদার আড়ালে গড়ে তুলেছিলেন এক অলিখিত আর্থিক সাম্রাজ্য। ইমেলদা মার্কোসের “জুতার সংগ্রহ” আজ ইতিহাসের খোরাক, বেনজীরের ৭২২টি টি-শার্ট কিংবা ১৯টি ফ্রিজ হয়তো সে পথেই হাঁটবে।

ইমেলদা মার্কোস ছিলেন এক সময়ের ‘ফার্স্ট লেডি’—জাঁকজমক, বিতর্ক ও লুটপাটের এক রমণীয় মুখ। আজ, বাংলাদেশে বেনজীর আহমেদ তার পরিবারের ভোগবিলাস, গোপন সম্পদ ও পালিয়ে যাওয়ার নাটকীয়তা দিয়ে যেন হয়ে উঠেছেন সেই ইমেলদার ছায়াস্বরূপ। পার্থক্য কেবল একটি—ইমেলদার নাম ইতিহাসে লেখা আছে দুর্নীতির প্রতীক হিসেবে, বেনজীর ও তার পরিবারের নাম থাকবে আদালতের রেকর্ডে, নিলামের খাতায় এবং নাগরিক ক্ষোভের দীর্ঘ তালিকায়।

বাসস-এর প্রতিবেদন অবলম্বনে

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

বিএনপি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়: আমীর খসরু

আমীর খসরু বলেন, অনেকে অনেক কিছু চাইবে, সব জায়গায় ঐকমত্য হবে না। তবে যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদের অবশ্যই জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণের প্রতি আস্থা না থাকলে পরাজিত শক্তির উত্থানের সুযোগ থাকবে।

৭ ঘণ্টা আগে

'তরুণরা ফাঁকা বুলি চায় না, চায় বাস্তব সুযোগ'

তারেক রহমান বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের অন্যতম দায়িত্ব হলো দেশের প্রতিটি ভোটারের আস্থা নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে, আজকের ও আগামী দিনের তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ছুটে যাচ্ছে তৃণমূল থেকে শুরু

৯ ঘণ্টা আগে

‘বিএনপির ৭ হাজারের বেশি সদস্য পদচ্যুত-বহিষ্কার’

১০ ঘণ্টা আগে

নর্থ সাউথ ভার্সিটির নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ গ্রেপ্তার ৭

১০ ঘণ্টা আগে