ঐতিহ্য

পহেলা বৈশাখের ইতিবৃত্ত

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
বাংলা নববর্ষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় রূপ নিয়েছে।

বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ শুধুই একটি দিন নয়, এটি এক অনন্য উৎসব, যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জীবনে আনন্দ আর মিলনের বার্তা নিয়ে আসে। বছরের প্রথম দিনে নতুন ক্যালেন্ডারের পাতার মতোই নতুন করে জীবনকে সাজিয়ে নেওয়ার সময় এটি। এই দিনটি যেন এক ফুরফুরে বাতাস নিয়ে আসে বাঙালি সমাজে—উৎসবের আমেজে ভরে ওঠে নগর থেকে গ্রাম, মাঠ থেকে অলি-গলি।

নববর্ষ মানেই বৈশাখী মেলা, রঙিন পোশাকে সজ্জিত নারী-পুরুষ, মুখে ও গালে ফুলকি আঁকা, আর চারপাশে ঢাক-ঢোল আর বাঁশির ছন্দ। এই দিনটিতে নারীরা পরে রঙিন আলপনামাখা সাদা-লাল শাড়ি, আর পুরুষেরা পাঞ্জাবি পরে বের হয় উৎসবে যোগ দিতে। শহরের বুকে কিংবা গ্রামের মাঠে, চারদিকেই আয়োজন থাকে বৈশাখী উৎসবের। এটি যেন বাঙালির সংস্কৃতির এক জাগ্রত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবছরই বর্ষবরণের আয়োজন আরও বেশি জমকালো হয়ে উঠছে। এখন স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারে ঘরে বসেও সবাই উপভোগ করতে পারে রমনার বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী সংগীতানুষ্ঠান। সেই সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রা—যা এখন ইউনেস্কো স্বীকৃত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য—ঢাকা থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা এবং গ্রামাঞ্চলেও। পথেঘাটে বসে বৈশাখী মেলা, পান্তা-ইলিশ আর হস্তশিল্পের বাহার মেলে ধরে বাঙালির শিল্প ও সংস্কৃতির সৌন্দর্য।

এই বৈশাখকে কেন্দ্র করে মানুষ যেন ফিরে যায় নিজের শিকড়ে। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশীদের সঙ্গে একত্র হয়ে দিনটি উদযাপন করা হয় আন্তরিকতায়। আর এই আনন্দ শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সামষ্টিক, অসাম্প্রদায়িক এবং সর্বজনীন। হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই মিলে বৈশাখের আনন্দ ভাগ করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে সম্প্রীতির এক দৃঢ় বন্ধন।

ফিরে দেখা নববর্ষ

বাংলা নববর্ষের ইতিহাসও কম সমৃদ্ধ নয়। বাংলা সালের সূচনা হয় মোগল সম্রাট আকবরের সময়, যার লক্ষ্য ছিল মূলত খাজনা আদায়ের সময় কৃষিকাজের সঙ্গে মিল রেখে নতুন একটি বর্ষপঞ্জি তৈরি করা। কারণ, তখন খাজনা আদায় করা হতো হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী, যা চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি মৌসুমের সঙ্গে ঠিক মিলত না।

এই সমস্যা সমাধানে সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে দায়িত্ব দেন একটি সৌরনির্ভর নতুন পঞ্জিকা প্রণয়নের জন্য। তিনি সৌর ও চান্দ্র বছরের মিলন ঘটিয়ে তৈরি করেন নতুন এক বর্ষপঞ্জি, যা ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়। পরে এটি বঙ্গাব্দ নামে প্রতিষ্ঠা পায়। তবে কার্যকর ধরা হয় আকবরের সিংহাসনে আরোহণের তারিখ ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে।

বাংলা মাসের নাম ও রীতির উৎস

বাংলা মাসগুলোর নামকরণও একদম বিজ্ঞাননির্ভর ও ঐতিহাসিক। বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায়, এই নামগুলো প্রাচীন নক্ষত্রপুঞ্জ বা তারকারাজির নাম থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমন—বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক ইত্যাদি। আগেকার দিনে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হতো, তাই একে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হতো। ‘অগ্র’ মানে প্রথম, আর ‘হায়ণ’ মানে বছর বা ধান—এই অর্থ থেকেই এসেছে ‘অগ্রহায়ণ’ নামটি।

এছাড়া সপ্তাহের সাতদিনের নামকরণও বাংলা সংস্কৃতির মধ্যে ইংরেজি নামের অনুকরণে প্রবর্তিত হয় মোগল সম্রাট শাহজাহানের সময়ে। ‘সানডে’ থেকে ‘রবিবার’, ‘মনডে’ থেকে ‘সোমবার’—এভাবে দিনগুলোর নামকরণ করা হয়, যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই তা মনে রাখতে পারে।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় নববর্ষ

আধুনিক প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের কল্যাণে বাংলা নববর্ষ উদযাপন এখন আরও বিস্তৃত ও বিস্ময়করভাবে আকর্ষণীয়। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আজ কয়েক কোটি বাঙালির ঘরে পৌঁছে যায়। শুধু রমনার বটমূলেই নয়, দেশের প্রতিটি শহর, জেলা, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও ছোট-বড় আয়োজন হয়। উন্মুক্ত কনসার্ট, লালন, বাউল, জারি-সারি, মুর্শিদি গানের আসর, পথনাটক ও হস্তশিল্পের মেলা—সব মিলিয়ে বাংলা নববর্ষ এক বিশাল সংস্কৃতি উৎসবে পরিণত হয়েছে।

শহরের শিশুদের জন্য এই দিনটিও এক আনন্দের উপলক্ষ। নাগরদোলা, হাতঘুড়ি, মাটির খেলনা, পুতুল নাচ—সবই যেন তাদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা বয়ে আনে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মেলা এখন শহরের অমলিন স্বাদ হিসেবেও দৃশ্যমান।

পহেলা বৈশাখ মানেই এক অনিবার্য অনুষঙ্গ—পান্তা-ইলিশ। অনেকের কাছেই দিনটি যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি না পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ আর কাঁচামরিচের সঙ্গে বাঙালিয়ানার পরিচয়টা মুখে তুলে নেওয়া হয়। অনেকে রমনার লেকপাড়ে বসেই আয়োজন করে ইলিশ-পান্তার আসর, আর এতে মিশে থাকে বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্বাদ।

পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। এটি কেবল একটি বর্ষবরণ উৎসব নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা বাঙালির স্বকীয়তা, ঐতিহ্য আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। বাংলা নববর্ষ মানুষকে শেখায় নতুন করে শুরু করার, পুরনো ভুলকে পিছনে ফেলে নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলার প্রেরণা।

সবচেয়ে বড় কথা, পহেলা বৈশাখ কোনো একক ধর্মীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। এটি পুরো জাতির এক মিলনমেলা। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, বয়স কিংবা পেশা—সব পার্থক্য ভুলিয়ে দিয়ে এক সঙ্গে পথচলার অনুপ্রেরণা দেয় এই দিনটি। এটাই পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় শক্তি।

এই উৎসবের মাধ্যমেই বারবার প্রমাণিত হয়, বাঙালি জাতি এক উজ্জ্বল সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। যতদিন বাংলা আছে, ততদিন থাকবে বৈশাখের আনন্দ, পান্তা-ইলিশের স্বাদ, আর থাকবে ঢাক-ঢোলের তালে উচ্ছ্বসিত প্রাণের উল্লাস।

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

আলী রীয়াজকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিয়োগ

মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদের সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অধ্যাপক আলী রীয়াজকে তার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগদান করেছেন।

১৯ ঘণ্টা আগে

ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত হচ্ছেন ঢাবির ভিসি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) হিসেবে ১৫ মাস দায়িত্ব পালন করার পর নতুন দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন ড. নিয়াজ আহমেদ খান। তাকে ডেনমার্কে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

২০ ঘণ্টা আগে

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি

আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, গণভোটে ‘হ্যাঁ’ রায় এলে জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়েই সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করা হবে, যে পরিষদ সংবিধান সংস্কার বিষয়ে সব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। এর মেয়াদ হবে ১৮০ দিন। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে পরিষদের কার্যক্রম সমাপ্ত হবে।

১ দিন আগে

সংসদে আসছে উচ্চকক্ষ, নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণ ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে আগামী জাতীয় সংসদের মধ্য দিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে, যেখানে সদস্য থাকবেন ১০০ জন। এ ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষে দেশের প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোট নেওয়া হলেও উচ্চকক্ষের সদস্য নির্ধারণ করা হবে সংখ্যানুপাতিক ভোট তথা পিআর পদ্ধতিত

১ দিন আগে