ইতিহাস

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
চ্যাটজিপিটির চোখে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ

হেমু সেই সময় পর্যন্ত ২২টি যুদ্ধ জয় করেছিলেন—সফলভাবে গৌড়, আগ্রা, কনৌজ, দিল্লি দখল করেছিলেন। তাঁর সেনাবাহিনীতে ছিল আফগান, রাজপুত এবং হিন্দু-মুসলিম মিলিত বাহিনী। এক বিশাল মিছিলের মতো তিনি দিল্লিতে প্রবেশ করেন বিজয়ীর বেশে, হাতির পিঠে বসে, সোনালী পতাকা হাতে। ইতিহাসবিদ আব্রাহাম আর. এর্লি মন্তব্য করেন, “হেমু সম্ভবত ভারতের ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজেকে নিজেই রাজ্যাভিষিক্ত করেছিলেন এমন সময়ে যখন সাম্রাজ্যভিত্তিক কর্তৃত্ব প্রায় অনুপস্থিত ছিল।”

এদিকে আকবর ও বায়রাম খাঁ তখন অবস্থান করছিলেন পাঞ্জাবে। দিল্লি হেমুর হাতে চলে যাওয়ার খবর পেয়ে তাঁরা কাবুল ও লাহোর থেকে সৈন্য ডেকে আনেন। পাশাপাশি উজবেক, তুর্কি এবং রাজপুত অনুগামীদেরও একত্র করেন। মুঘল বাহিনী তখন মূলত প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে ছিল, কারণ তাদের অভিজ্ঞ সৈন্যসংখ্যা হেমুর বাহিনীর তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বায়রাম খাঁর কৌশল ছিল স্পষ্ট—যুদ্ধ হবে দ্রুত, কেন্দ্রে ধাক্কা দিতে হবে, আর হেমুর নেতৃত্বকে লক্ষ্য করতে হবে। কারণ হেমু ছিলেন সেই সেনাবাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু—তাঁকে সরিয়ে দেওয়া মানেই হয়তো নেতৃত্বহীন এক বিশাল বাহিনী ভেঙে পড়বে।

১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর সকাল। হালকা কুয়াশা ঢাকা পানি পথের ময়দান। উভয় পক্ষের বাহিনী প্রস্তুত। হেমুর বাহিনীতে ছিল প্রায় ৩০,০০০ পদাতিক, ১৫০০ যুদ্ধহাতি এবং প্রচুর অশ্বারোহী। মুঘল বাহিনীর ছিল তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যা, তবে ছিল অভিজ্ঞ তুর্কি-উজবেক তীরন্দাজ ও কয়েকজন সাহসী রাজপুত নেতার নেতৃত্বে বিশেষ স্কোয়াড।

হেমু নিজের বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সামনে থেকে। তিনি সাঁজোয়া যুদ্ধহাতিতে বসে ছিলেন, হাতে ছিল বিক্রমাদিত্যের চিহ্ন সম্বলিত ধ্বজা। শুরুতেই হেমুর বাহিনী মুঘলদের ওপর আক্রমণ করে এবং প্রাথমিক ধাক্কায় অনেক মুঘল সৈন্য হতাহত হয়। মুঘল সেনাপতি আলী কুলি খান এক পর্যায়ে বলেছিলেন, “যদি সেনাপতিকে এখনই লক্ষ্য না করি, সব শেষ।”

বেলা গড়িয়ে আসছিল। যুদ্ধের উত্তাপ বাড়ছিল। তখনই ঘটে এক নাটকীয় মুহূর্ত—একটি তীর এসে হেমুর চোখ বিদ্ধ করে। রক্তাক্ত হেমু তাঁর হাতি থেকে পড়ে না গেলেও অজ্ঞান হয়ে যান। যেহেতু তিনি নিজের বাহিনীর একমাত্র কমান্ডার ছিলেন, সৈন্যরা তাঁকে মৃত ভেবে পশ্চাদপসরণ করে। সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। মুঘল বাহিনী তখন একযোগে আক্রমণ করে, এবং হেমুর হাতির মাহুতকে বাধ্য করা হয় হাতি নামিয়ে দিতে। বন্দি হেমুকে নিয়ে যাওয়া হয় আকবরের তাঁবুতে।

সেখানে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ঘটে। বায়রাম খাঁ কিশোর আকবরকে উৎসাহ দেন হেমুর শিরচ্ছেদ করতে—যাতে সে একজন সত্যিকারের ‘গাজী’, অর্থাৎ কাফির জয়ী সম্রাট হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হতে পারে। যদিও অনেকে বলেন, আকবর নিজ হাতে শিরচ্ছেদ করেননি, বরং নির্দেশ দেন মাত্র। পরবর্তী সময়ের মুঘল ইতিহাস এই ঘটনাকে প্রচারের মাধ্যমে মহিমা দেওয়ার চেষ্টা করে।

এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক স্যার ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’-তে। তিনি বলেন, “যদি সেই মুহূর্তে হেমু আহত না হতেন, তবে মুঘলরা হয়তো ভারত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।” তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুদ্ধটি সামরিক দক্ষতার চেয়ে ভাগ্য ও নেতৃত্বে আঘাত লাগার ফলেই নির্ধারিত হয়।

এই যুদ্ধের পর মুঘলরা ফের দিল্লি ও আগ্রা দখল করে। হেমুর পরিবারের সদস্যরা, যারা পূর্ব ভারতে ছিলেন, তাঁদের অনেককেই আটক বা হত্যা করা হয়। তাঁর অনুগামীদের অনেককেই ধর্মান্তর অথবা মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়।

এই যুদ্ধের তাৎপর্য বহু দূরপ্রসারী। এটি কেবল আকবরের সিংহাসনকে রক্ষা করেনি, বরং তাকে এমন এক পথে ঠেলে দেয় যেখানে সে এক একীভূত, দীর্ঘস্থায়ী, এবং তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল সাম্রাজ্যের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে।

আগামী অংশে আমরা আলোচনা করব এই যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তন, আকবরের শাসনের নতুন রূপরেখা, এবং হেমু–আকবর সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া।

পানি পথের ময়দানে বিজয়ের মাধ্যমে আকবর কেবল দিল্লি জয় করেননি, জয় করেছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎও। ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বরের সেই দিনটি ছিল একটি মোড়বদলের সূচনা, যার প্রভাবে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্র, শাসনব্যবস্থা ও ধর্মীয় সহনশীলতার ধারণা নতুন রূপ পায়।

যুদ্ধশেষে প্রথম যে কাজটি হয়, তা হলো দিল্লি ও আগ্রার পুনর্দখল। আকবর ও বায়রাম খাঁ ধাপে ধাপে সূরি সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট প্রতিরোধগুলো দমন করতে থাকেন। অনেক আফগান নেতাকে হয় হত্যা করা হয়, নয়তো আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। হেমুর পরিবার, যারা পূর্ব ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদেরও অনেককে বন্দি করা হয়। কট্টর সামরিক বিজয়ের পর শুরু হয় প্রশাসনিক পুনর্গঠন।

তবে আকবর খুব দ্রুতই বুঝতে পারেন, একটি সাম্রাজ্য শুধু তরবারির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। এর জন্য প্রয়োজন একটি দৃঢ় প্রশাসন, প্রজাদের আস্থা এবং শাসনব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা। এখানে এসে আমরা দেখি, আকবর ধীরে ধীরে তাঁর অভিভাবক বায়রাম খাঁ-এর ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজস্ব শাসনশৈলী গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।

তবে এই উত্তরণের পথটি মসৃণ ছিল না। বায়রাম খাঁ অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। তরুণ আকবরের হয়ে যুদ্ধ করে যিনি সাম্রাজ্য রক্ষা করেছিলেন, এখন তাঁর কর্তৃত্ব ক্রমেই সম্রাটের স্বাধীনতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। ইতিহাসবিদ ইরানী গবেষক আতাউল্লাহ ইয়াজ্দি তাঁর গ্রন্থে লেখেন—“বায়রাম খাঁ যেন এক ছায়া-সম্রাটে পরিণত হয়েছিলেন, একজন অভিভাবক যিনি শাসনের দায়িত্বকেই শাসনাধিকারে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।”

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

আইন ভঙ্গ : যুক্তরাষ্ট্রের ৬ হাজার বিদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল

বিবিসি জানায়, ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসননীতি ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ওপর নজরদারির অংশ হিসেবেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যদিও ‘সন্ত্রাসবাদে সহায়তা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা পরিষ্কার করেনি স্টেট ডিপার্টমেন্ট।

১৬ ঘণ্টা আগে

ইসরায়েলি হামলা গাজায় নিহত ছাড়াল ৬২ হাজার

গাজায় উদ্ধার প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ভুক্তভোগী এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন অথবা রাস্তায় পড়ে আছেন তবে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ এবং সরঞ্জামের অভাবে জরুরি দল তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না।

১৬ ঘণ্টা আগে

এবার পুতিন-জেলেনস্কিকে মুখোমুখি নিয়ে বসবেন ট্রাম্প

এ বৈঠকের দিন-তারিখ নিয়ে অবশ্য কোনো তরহ্য মেলেনি। নির্ধারণ হয়নি বৈঠকের স্থানও। তবে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্ৎস আভাস দিয়েছেন, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ত্রিপাক্ষিক বৈঠকটি হতে পারে।

১৮ ঘণ্টা আগে

বৈঠকে ট্রাম্প-জেলেনস্কি, যেসব শর্ত আলোচনায়

বৈঠকের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধে অনেক অগ্রগতি হচ্ছে। এ সময় জেলেনস্কি বলেন, কূটনৈতিকভাবে যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনায় ইউক্রেনের সমর্থন আছে।

১ দিন আগে