ইতিহাস

ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ!

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
শিল্পির তুলিতে মেগিড্ডোর যুদ্ধ

যত পুরনো মানবসভ্যতা, যুদ্ধের ইতিহাসও ততটাই পুরনো। ঠিক কবে প্রথম মানুষ একে-অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছিল, তা বলা মুশকিল। কারণ, ইতিহাসে লিখে রাখার অভ্যাস শুরু হয়েছে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। তারও অনেক পর থেকে আমরা সংগঠিতভাবে যুদ্ধের কথা জানতে পারি।

আমরা যাকে লিখিত ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ বলে জানি, সেটি হলো মেগিড্ডোর যুদ্ধ। এই যুদ্ধ হয়েছিল প্রায় ৩,৫০০ বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে। মিশরের তৎকালীন ফারাও (রাজার পদবি) তৃতীয় থুতমোস এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, মিশরের থিবস শহরের এক মন্দিরের গায়ে খোদাই করে রাখা হয়েছিল এর বিস্তারিত বিবরণ।

মেগিড্ডো ছিল একটি প্রাচীন শহর, যার অবস্থান ছিল আজকের ইসরায়েলে, নাজারেথ শহরের কাছে। এই শহর ছিল মিশর আর মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান ইরাক ও আশপাশের অঞ্চল) মধ্যে বাণিজ্যপথের মাঝখানে। ফলে শহরটি কৌশলগতভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এই অঞ্চলে আগে মিশরের কর্তৃত্ব থাকলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই দখল শিথিল হয়ে পড়ে। স্থানীয় নেতারা তখন স্বাধীনভাবে শহর চালাতেন, নামমাত্র আনুগত্য দেখাতেন মিশরের প্রতি।

থুতমোসের জন্ম হয় মিশরের রাজপরিবারে। তার বাবা দ্বিতীয় থুতমোস মারা গেলে, তিনি অনেক ছোট ছিলেন। তখন তার জন্য রাজকার্য সামলান রানী হাশেপ্সুত, যিনি খুবই দক্ষ শাসক ছিলেন। তিনি যুদ্ধ না করেও সামরিক শক্তি বাড়িয়েছিলেন।

হাশেপ্সুতের মৃত্যুর পর তরুণ থুতমোস পুরোপুরি ফারাও হন। এরপর প্রায় ২০ বছর তিনি মিশরীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন এবং অনেকগুলো যুদ্ধ জেতেন। তার প্রথম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধই ছিল মেগিড্ডোর যুদ্ধ।

তখন মিশরের সাম্রাজ্য একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে, মেসোপটেমিয়ার কিছু শক্তিশালী রাজ্য (যেমন হিট্টাইট, মিটান্নি, কাসাইট) এবং কানানের (আজকের লেবানন-ইসরায়েল) কিছু নগররাষ্ট্র একজোট হয়ে মিশরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় কাদেশ নামের শহরের রাজা দুরুশা। সে মেগিড্ডো শহরে ঘাঁটি গেড়ে মিশরের ব্যবসাপথে বাধা সৃষ্টি করতে চায়।

ফারাও থুতমোস তৈরি করেন এক বিশাল বাহিনী, প্রায় ২০ হাজার সৈন্য। তারা থিবস থেকে যাত্রা করে মেগিড্ডোর দিকে রওনা হয়। মাঝপথে এসে তিনটি রাস্তার মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হয়—একটি ছিল খুবই সরু ও বিপদজনক।

জেনারেলরা যখন নিরাপদ পথ নিতে বলেন, তখন ফারাও থুতমোস ঠিক করেন বিপজ্জনক পথটাই নেবেন, কারণ শত্রু বুঝবে না এই দিক থেকে আক্রমণ আসবে। সেই ভাবনাই তাকে সাফল্য এনে দেয়।

থুতমোসের সেনারা হঠাৎ করে মেগিড্ডোর পাশে উপস্থিত হয়। শত্রুপক্ষ এত তাড়াতাড়ি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে তারা বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে যায়। মিশরীয় রথবাহিনী ও সৈন্যদের তীব্র আক্রমণে শত্রু সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।

অনেক সৈন্য নিহত হয়, অনেক আহত হয়। কাদেশের রাজা ও তার কিছু সেনা শহরে পালিয়ে যায়। কিন্তু তখন শহরের গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, তারা দেয়ালের উপর দিয়ে দড়ি বেয়ে ভেতরে ঢোকে।

এই সময় যদি ফারাও আক্রমণ করতেন, তাহলে শহরটা হয়তো তখনই দখল হয়ে যেত। কিন্তু মিশরীয় সৈন্যরা লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ফলে সুযোগটা নষ্ট হয়ে যায়।

এর ফলে ফারাওকে প্রায় সাত মাস শহর ঘিরে রাখতে হয়। শেষে শহর আত্মসমর্পণ করে। ফারাও দয়াপরবশ হয়ে শহরের শাসক ও নাগরিকদের প্রাণে মারেন না, কিন্তু তাদের শর্তহীন আনুগত্য নিতে বাধ্য করেন।

এই বিজয়ের ফলে থুতমোস মিশরের এক শক্তিশালী শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। মেগিড্ডো জয়ের মাধ্যমে তিনি কানান অঞ্চলে মিশরের প্রভাব ফেরাতে সক্ষম হন। আবার মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে মিশরের বাণিজ্যপথও নিরাপদ হয়ে ওঠে।

তবে কাদেশের রাজা পালিয়ে যাওয়ায় কিছু শহরে বিদ্রোহ চলতেই থাকে। মিটান্নি ও অন্যান্য শক্তির সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই চললেও, থুতমোস মিশরের সীমা অনেকটা বাড়াতে সক্ষম হন।

এই যুদ্ধ শুধু মিশরীয় ইতিহাসেই নয়, গোটা বিশ্বের ইতিহাসেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটাই ছিল লিখিত ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ, যার বিশদ বিবরণ আমাদের জানা আছে।

আবার বাইবেলের "বুক অব রিভিলেশন"-এ ‘আর্মাগেডন’ নামে যে চূড়ান্ত যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, সেটিও এই মেগিড্ডো নাম থেকেই এসেছে। ‘আর্মাগেডন’ আসলে মেগিড্ডোর গ্রীক নাম।

মেগিড্ডোর যুদ্ধ শুধু এক জয়ের গল্প নয়, বরং কৌশল, সাহস আর সময়মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অসাধারণ এক উদাহরণ। এটি আমাদের শেখায়, ইতিহাসে কেবল শক্তিই নয়, চিন্তা আর দূরদর্শিতাও বড় ব্যাপার।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

হংকংয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৪ জনের মৃত্যু

অ্যাপার্টমেন্টগুলোর জানালা দিয়ে আগুনের শিখা বেরোতে দেখা গেছে। গোটা এলাকা ঢেকে গেছে ঘন কালো ধোঁয়ায়। দমকলকর্মীরা উঁচু মই ব্যবহার করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। দমকল বাহিনীর চেষ্টায় আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও এখনও পুরোপুরি নেভানো যায়নি।

১৯ ঘণ্টা আগে

বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল শহর ঢাকা: জাতিসংঘ

জনবহুল শহরের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপানের রাজধানী টোকিও। তবে জাকার্তা এবং ঢাকার তুলনায় গত ২৫ বছরে শহরটির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে।

১ দিন আগে

হংকংয়ে একাধিক ভবনে আগুন, বহু হতাহতের শঙ্কা

হংকংয়ের উত্তরাঞ্চলীয় তাই পো জেলার ওয়াং ফুক কোর্ট নামের বৃহৎ আবাসিক এলাকায় একাধিক টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি মুহূর্তেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, আর এতে বহু হতাহতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দমকল ও জরুরি সেবা বিভাগ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে

১ দিন আগে

থাইল্যান্ডে ৩০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ বৃষ্টি, নিহত ৩৩

থাইল্যান্ডে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত হয়েছেন এবং লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে এই দুর্যোগের ফলে বহু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনেক মানুষ গৃহহীন হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

১ দিন আগে