ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া 'বেআইনি' হয়েছে, কলকাতা হাইকোর্টের রায়

বিবিসি বাংলা
ভারত থেকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া নিয়ে মাইলফলক রায় কলকাতা হাইকোর্টের - প্রতীকী ছবি

যে গর্ভবতী ভারতীয় নারী 'অবৈধ বাংলাদেশি' সন্দেহে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলে বন্দি রয়েছেন, তাকে আটক করা এবং বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া বেআইনি কাজ হয়েছে বলে জানিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট।

তার সঙ্গে আরও যে পাঁচজনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, সবাইকেই চার সপ্তাহের মধ্যে ভারতে ফিরিয়ে আনতে হবে বলে বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও ঋতব্রত মিত্রর বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে।

গত মাস চারেক ধরে যেভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অনেক ভারতীয় নাগরিককে, সেই 'পুশ-আউট'এর ক্ষেত্রে এই নির্দেশ একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

সোনালি খাতুন নামে ওই গর্ভবতী নারী সহ মোট ছয়জনকে দিল্লি থেকে আটক করে সেখানকার পুলিশ।

'বাংলাদেশি' বলে সীমান্ত দিয়ে তাদের পুশ আউট করে দেওয়া হয়েছিল এদের। যদিও তারা আটক হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পুলিশ একাধিক নথি জোগাড় করে দিল্লি পুলিশের কাছে পাঠিয়েছিল, যাতে দেখা গিয়েছিল যে সোনালি খাতুন সহ ছয়জনই ভারতের নাগরিক।

ভারত থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পরে তারা বেশ কিছুদিন বাংলাদেশেরই কোনও একটা এলাকায় ছিলেন। তারপরে তারা বাংলাদেশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে সোনালি খাতুন সহ বাকি ধৃতরা এখন ওই জেলার কারাগারেই বন্দি আছেন।

জন্মের আগেই ভারতে 'অনুপ্রবেশ'?

সোনালি খাতুনের হয়ে তার বাবা যে রিট পিটিশন করেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টে, সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতিরা জানিয়েছেন যে সোনালি খাতুন, তার স্বামী ও সন্তানকে আটক করাটাই বেআইনি কাজ হয়েছিল। এই তিনজনের সঙ্গে আরও একটি পরিবারের তিন সদস্যকেও আটক করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

দুটি পরিবারের দায়ের করা পৃথক দুটি রিট পিটিশনের আলাদা করে রায় হয়েছে শুক্রবার। দুই ক্ষেত্রেই একই নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

বিচারপতিরা কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন যে চার সপ্তাহের মধ্যে তাদের সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।

দিল্লি পুলিশ এই ছয়জনকে আটক করার মাত্র দুদিনের মধ্যে তাদের প্রত্যর্পণের নির্দেশ দেয় সেখানকার 'ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস'।

এই মামলার শুনানিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার দোসরা মে তারিখে জারি করা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা একটি 'নির্দেশিকা'র কথা উল্লেখ করেছেন।

ওই নির্দেশিকা অনুযায়ী বিদেশি সন্দেহে কাউকে আটক করা হলে তার পরিচয় যাচাইয়ের জন্য সর্বোচ্চ ৩০ দিন আটক রাখা যেতে পারে। তবে সোনালি খাতুনদের ক্ষেত্রে মাত্র দুদিনের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ করা হয় বলে আদালত নজর করেছে।

তাদের আটক করা হয় ২৪শে জুন, আর বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ২৬শে জুন।

বিচারপতিরা পর্যবেক্ষণ করেছেন, বীরভূম জেলার যে পাইকর থানা এলাকার বাসিন্দা বলে দাবি করেছিল এই পরিবারটি, সেই থানা থেকে এদের সকলের পরিচয় যাচাই করে তা দিল্লি পুলিশের কাছে পাঠানো হয় ১০ই জুলাই তারিখে।

অর্থাৎ, নির্দেশিকাতে উল্লেখিত ৩০ দিনের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এদের পরিচয় যাচাই করে দিল্লিতে জানিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই এদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

অতি দ্রুততার সঙ্গে এদের প্রত্যর্পণ করতে গিয়ে দিল্লি পুলিশ যে বড় ভুল করেছে, সেটা আদালতের রায়ে একাধিকবার উঠে এসেছে।

এক জায়গায় বিচারপতিরা উল্লেখ করেছেন যে, অভিযোগে বলা হয়েছে তারা "১৯৯৮ সালের কোনও সময়ে বেআইনি ভাবে ভারতে প্রবেশ করেন। তবে সোনালির আধার কার্ড এবং প্যান কার্ডে তার যে বয়স লেখা আছে ২৬ বছর, অর্থাৎ তার জন্ম হয়েছিল ২০০০ সালে। তাই সোনালি ১৯৯৮ সালে ভারতে এসে থাকতে পারেন না।"

কলকাতা হাইকোর্ট তাদের রায়ে উল্লেখ করেছে যে বিদেশি আইন অনুযায়ী একজন সন্দেহভাজন বিদেশির ওপরেই তার নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করার দায় বর্তায়।

আদালত বলেছে, "তবে আইনের ওই ধারা প্রশাসনকে এই ক্ষমতা দেয় নি, যে কাউকে বেছে নিয়ে তার বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে বলতে পারবে যে আপনি বিদেশি। প্রাথমিকভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু প্রমাণ বা তথ্য থাকতে হবে, যার ভিত্তিতে একজনকে সন্দেহ করা যেতে পারে যে তিনি বিদেশি, ভারতীয় নন।"

পুরো রায়ে আদালত মন্তব্য করেছে যে দিল্লি পুলিশের অতি উৎসাহ, অতি দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়ে যাওয়া যে সোনালি খাতুন সহ ছয়জন ভারতীয় নন, দুদিনের মধ্যে তাদের প্রত্যর্পণ করে দেওয়া এবং থানায় চাপ দিয়ে জবানবন্দি আদায় করা সহ একাধিক নেতিবাচক মন্তব্য করেছে।

'মাইলফলক' রায়

প্রায় চার মাস ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে 'অবৈধ বাংলাদেশি' চিহ্নিত করার জন্য বিশেষ অভিযান চলছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এবং নানা মানবাধিকার সংগঠন ও পরিযায়ী শ্রমিক সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে যে এই রাজ্য থেকে অন্য প্রদেশে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা বাংলায় কথা বললেই বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ সন্দেহ করছে যে তারা বাংলাদেশি।

একাধিক ঘটনা সামনে এসেছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের বৈধ বাসিন্দাদেরও 'অবৈধ বাংলাদেশি' বলে আটক করে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

এরকম অন্তত ১৫ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে বলে পরিযায়ী শ্রমিক সংগঠনগুলি।

তবে কারও ক্ষেত্রেই মামলা হয় নি।

সোনালি খাতুন সহ ছয়জনের মামলাটিকে তাই 'মাইলফলক' রায় বলে মনে করছে মানবাধিকার ও পরিযায়ী শ্রমিক সংগঠনগুলি।

পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান ও তৃণমূল কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম বলছিলেন যে এই রায়ের পরে 'অবৈধ বাংলাদেশি' খোঁজার নাম করে পশ্চিমবঙ্গর বাংলাভাষী মানুষকে হেনস্থা করা থেকে বিরত থাকা উচিত বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশের।

"কিভাবে পরিচয় যাচাই না করে দুদিনের মধ্যে বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দিতে পারল দিল্লি পুলিশ আর দিল্লির এফআরআরও? এই দুটি পরিবারের পূর্বপুরুষদের সব নথি আছে, তা সত্ত্বেও তাদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে দিল! পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে প্রথম থেকে আমরা এই দুটি পরিবারের পাশে থেকেছি, আইনি সহায়তা দিয়েছি। না হলে হয়তো এদের বাংলাদেশি বলেই প্রমাণ করে দিত। এটা মানুষের জয়।"

পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক বলছেন যে ভিন রাজ্যে যেসব মানুষ কাজ করতে যান, তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কলকাতা হাইকোর্টের এই রায় এক 'মাইলফলক'।

তার কথায়, "সীমান্তবর্তী এলাকার শ্রমিকরা যখন ভিন রাজ্যে কাজে যান, তাদের একটা আতঙ্ক থাকে যে তাদের হয়তো বাংলাদেশি বলে পুশ-আউট করে দেবে। এই মাইলফলক রায়ে তাদের আতঙ্ক কিছুটা কমবে, কারণ হাইকোর্ট স্পষ্ট করেই বলেছে যে আইন বহির্ভূত ভাবে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া যাবে না। বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ ও কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা আরও বেড়ে গেল।"

গর্ভবতী ভারতীয়র চিকিৎসা জেলেই

ধরা পড়ার সময়েই সোনালি খাতুন যে গর্ভবতী ছিলেন, সেটা বিবিসির কাছে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ পুলিশ।

বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিবিসি বাংলাকে সম্প্রতি বলেছিলেন, "যেদিন তাদের গ্রেফতার করা হয়, সেদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা চেষ্টা করেছিলাম যে যদি ভারতে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আমরা জানিয়েছিলাম। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আমরা এদের আদালতে তুলি এবং সেখান থেকে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গ্রেফতার হওয়ার সময়েই আমরা জানতাম যে ওই নারী গর্ভবতী।"

সোনালি খাতুন এখন প্রায় আট মাসের গর্ভবতী বলে জানা গেছে। কিন্তু তার সন্তান যদি বাংলাদেশেই ভূমিষ্ঠ হয়, তাহলে তার নাগরিকত্ব কী হবে, তা নিয়ে আশংকা তৈরি হয়েছিল।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কারাগারের জেলার মোহাম্মদ জাকির হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে, ওই গর্ভবতী নারীর শরীর-স্বাস্থ্যের ওপরে কারাগারের ডাক্তাররাই নজর রাখছেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছেন।

তার কথায়, "আমাদের জেলের কোনও হাসপাতাল নেই। আমাদের যে ডাক্তার আছেন, তিনিই রেগুলার ট্রিটমেন্ট দেন। এর বাইরে প্রয়োজন হলে তাকে বাইরের হাসপাতালে নিতে হবে। এখনও পর্যন্ত তিনি ভালই আছেন।"

ভারতীয় পরিচয় নিশ্চিত করেছিল পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ

যে ছয়জন এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কারাগারে আটক রয়েছেন, তাদের মধ্যে দুটি পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন।

যে নারী গর্ভবতী অবস্থায় আটক আছেন, সেই সোনালি খাতুন, তার স্বামী দানেশ শেখ ও তাদের ছেলে সাবির শেখ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পাইকর থানার বাসিন্দা।

অন্য পরিবারটির বাড়ি বীরভূমেরই মুরারই থানা অঞ্চলের ধিতোরা গ্রামে। সেই পরিবারের এক নারী সুইটি বিবি ও দুই ছেলে – ১৬ বছর বয়সী কুরবান শেখ ও ছয় বছরের ইমাম শেখও চাঁপাই নবাবগঞ্জের জেলে আটক রয়েছেন।

এদের সকলকেই পশ্চিম দিল্লির রোহিনী এলাকার কেএন কাটজু মার্গ থানা 'বাংলাদেশি' সন্দেহে আটক করে। এরপর তাদের পশ্চিম দিল্লির ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসারের সামনে হাজির করানো হয়।

ওই দফতরটি বিদেশি ট্রাইব্যুনালের মতো কাজ করে থাকে। সেখান থেকে রায় দেওয়া হয় যে, এরা সকলেই বাংলাদেশি এবং সেদেশে এদের ঠিকানা বাগেরহাট জেলায়।

তবে বীরভূমের পুলিশ একাধিক নথি জোগাড় করে নিশ্চিত হয়েছে যে এরা সকলেই ভারতীয়।

পুলিশের জোগাড় করা নথি ছাড়াও তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম এমন কয়েকটি জমির দলিলের তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যেগুলো বাংলাদেশি হিসেবে দেখানো একজন নারীর মায়ের ও বাবার - উভয় দিকের পূর্বপুরুষদের।

এই সব দলিল ১৯৫০, ১৯৬০ বা ১৯৭০-এর দশকের।

এত কিছু প্রমাণ দাখিল করার আগেই দিল্লি থেকে নিয়ে এসে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল দুটি পরিবারের ছয়জনকে।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ইসরাইলকে সাহায্য করা ১১ দেশের ১৫৮ কোম্পানির তালিকা প্রকাশ

৪ ঘণ্টা আগে

গাজায় ২৪ ঘণ্টায় প্রাণহানি ৬০, নিহতের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৪৯ জনে পৌঁছেছে

৫ ঘণ্টা আগে

নেতানিয়াহুর বক্তব্য শুরুর সাথে সাথে খালি জাতিসংঘের অধিবেশন কক্ষ

তাদের এ ওয়াক আউট থেকে নজর সরাতে নেতানিয়াহুর সমর্থকরা জোরে জোরে তালি দেয় বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইসরায়েল। এরমধ্যে নেতানিয়াহুর স্ত্রী ও নিউইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামসও রয়েছেন।

১৮ ঘণ্টা আগে

ট্রাম্পের ভিসা নীতিতে ভারতের আইটি খাতের তরুণদের মধ্যে ‘আতঙ্ক’

কিন্তু যে ‘এইচ ওয়ান-বি’ ক্যাটাগরির ভিসায় স্বপ্নিলের মতো টেক বা মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটদের মার্কিন কোম্পানিগুলো এতদিন চাকরি দিয়ে নিয়ে যেত, সেটার ফি গত ২০ সেপ্টেম্বরের পর থেকে এক লাফে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ লাখ ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯০ লাখ রুপি)! এই অঙ্ক এইচ ওয়ান-বি ভিসায় আমেরিকায় গিয়ে যারা চাকরি করছেন,

২১ ঘণ্টা আগে