এসএসসির ফল: গণিত-ইংরেজির ধাক্কার সঙ্গে আলোচনায় 'গ্রেস মার্কস'

সজীব রহমান
এসএসসির ফলাফলের পর শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে। ছবি: ফোকাস বাংলা

দেড় দশক পর এসএসসিতে সারা দেশের সব শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে গড় পাসের হার নেমেছে ৭০ শতাংশের নিচে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ কম। গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও৷

বিষয়ভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এ বছর পাসের হারে এই ধসের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে গণিতের ফলাফল। সব বোর্ডেই সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে এ বিষয়টিতেই৷ এ ছাড়া ইংরেজি বিষয়েও পাসের হার অনেকটাই কম। এর বাইরে এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে 'গ্রেস মার্কস' না থাকাকেও ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ার অন্যতম কারণ মনে করা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) এ বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এ ছাড়া এ বছর এক লাখ ৩৯ হাজার ৩২ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে, যা গত বছর পেয়েছিল এক লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন।

এ বছর পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়াকে অনেকেই ফলাফলে 'ধস' মনে করছেন। তবে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি বলছে, এটি শিক্ষার্থীদের 'প্রকৃত অর্জন'। আগে শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়নে ছাড় দেওয়া হলেও এবারের ফলাফল তাদের মেধা ও পড়ালেখার বাস্তব প্রতিফলন।

গণিত-ইংরেজিতে কুপোকাত

সাধারণ ৯ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে রাজশাহী বোর্ডে। পাসের হারে দ্বিতীয় ও তৃতীয় যথাক্রমে যশোর (৭৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ) ও চট্টগ্রাম (৭২ দশমিক ০৭ শতাংশ)। এ ছাড়া সিলেট বোর্ডে ৬৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ঢাকায় ৬৭ দশমিক ৫১ শতাংশ, দিনাজপুরে ৬৭ শতাংশ ও কুমিল্লায় ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।

পাসের হার সবচেয়ে কম এসেছে ময়মনসিংহ ও বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে— যথাক্রমে ৫৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ ও ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হাত ৬৮ দশমিক ০৯ শতাংশ, কারিগরিতে ৭৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

বোর্ডগুলোর ফলাফল বলছে, শিক্ষার্থীরা এবার সবচেয়ে ভালো করেছে বাংলায়। বরিশাল বাদে বাকি সব শিক্ষা বোর্ডেই এ বিষয়ে পাসের হার ৯৫ শতাংশের বেশি, দিনাজপুর বোর্ডে যা ৯৯ শতাংশ পেরিয়ে গেছে৷ এর বিপরীতে গণিতে কোনো বোর্ডেই পাসের হার ৯০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি। রাজশাহী ছাড়া বাকি সব শিক্ষা বোর্ডেও ইংরেজিতে পাসের হার ৯০ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে এ বিষয়ে পাসের হার ৭০ শতাংশেরও কম।

গণিত বিষয়ে পাসের হার রাজশাহী বোর্ডে গণিতে ৮৬ দশমিক ৫২ শতাংশ, ঢাকা বোর্ডে ৭৫ দশমিক ১৪ শতাংশ, কুমিল্লায় ৭২ দশমিক ০২ শতাংশ, যশোরে ৮৫ দশমিক ০২ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৮১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, বরিশালে ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ, সিলেটে ৮৩ দশমিক ১৭ শতাংশ, দিনাজপুরে ৭১ দশমিক ৩৫ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ৬৪ দশমিক ২৭ শতাংশ।

অন্যদিকে ইংরেজিতে পাসের হার রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ৯৩ দশমিক ১০ শতাংশ, ঢাকায় ৮৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ, কুমিল্লায় ৮৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যশোরে ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৮৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, বরিশালে ৬৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ, সিলেটে ৮৯ দশমিক ৬১ শতাংশ, দিনাজপুরে ৮৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ৮৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

এ ছাড়া মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯২ দশমিক ২ শতাংশ, গণিতে ৭৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ, গণিতে ৮৮ দশমিক ৭২ শতাংশ।

SSC Result Viqarunnisa Noon School 02 Photo 10-07-2025

এসএসসির ফলাফলের পর রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস। ছবি: ফোকাস বাংলা

কেন কমলো পাসের হার

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সারা দেশে পাসের হার দেড় দশকের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম। শুধু গত বছরের তুলনায়ই পাসের হার কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। ফলে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফলে ধস নেমেছে কি না, সে প্রশ্নটি বেশ আলোচিত হচ্ছে।

এর পেছনে গণিত ও ইংরেজিতে ফল খারাপ হওয়ার প্রভাব সুস্পষ্ট। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকারের পর্যবেক্ষণও বলছে, গণিত ও ইংরেজির ফলাফল এসএসসির সার্বিক ফলাফলে বড় প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, এসএসসিতে ফলাফলের শতাংশ নির্ভর করে গণিত ও ইংরেজির মতো বিষয়ের ওপর। অনেক সময় প্রশ্ন কঠিন হলে তার প্রভাব পড়ে ফলাফলে। এবার হয়তো প্রশ্ন কঠিন হয়েছে।

মফস্বলে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের ভালো শিক্ষকের সংকটের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক তপন বলেন, বিশেষ করে মফস্বলে ইংরেজি ও গণিতের দক্ষ ও ভালো শিক্ষকের সংকট রয়েছে। ফলে এর প্রভাব পড়ে এসএসসি পরীক্ষায় সরকার এ দিকে নজর দিলে হয়তো গণিত ও ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা ভালো করতে পারবে।

এর বাইরে উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়ি তথা 'গ্রেস মার্কস' না থাকাও একটি কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, এবারের ফল প্রস্তুতিতে পরীক্ষকদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল— শিক্ষার্থীর খাতায় যা আছে, নম্বর শুধু সেটুকুই দিতে হবে। গ্রেস মার্কস বা কোনো অতিরিক্ত নম্বর বা নম্বর বাড়িয়ে ভালো গ্রেড দেওয়ার সুযোগ ছিল না।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন এ প্রসঙ্গে বলেন, ফলাফল অন্য বছরের চেয়ে খারাপ হওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ। তবে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি যে বোর্ড থেকে বলে দিত, তেমন না। শিক্ষকরা হয়তো কাউকে ভালো গ্রেডের কাছাকাছি নম্বর থাকলে একটু বাড়িয়ে দিতেন। এবার এ বিষয়ে কড়াকড়ি করা হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলে।

এদিকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিল ২০২০ সালে। ওই সময় করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এর ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ঘাটতি থেকে গেছে।

আবার গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরতে বেশ কয়েক মাস সময় লেগেছে৷ এ সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখাও ব্যাহত হয়েছে। ফলাফলে গিয়ে এর প্রভাবই পড়েছে।

'শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অর্জনের প্রতিফলন'

পাসের হার বা জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়াকে অনেকেই এবারের এসএসসিতে ফল বিপর্যয় হিসেবে দেখছেন৷ তবে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি বলছে, এ ফলাফলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়েছে।

এবারের এসএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘শূন্য উদারনীতি’ অনুসরণ করা হয়েছে জানিয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক এহসানুল কবির ম বলেন, শিক্ষার্থীরা খাতায় যা লিখেছে, সে অনুযায়ী নম্বর পেয়েছে। কোনো উদারনীতি অবলম্বন করা হয়নি। আমরা চাই সত্যিকারের মেধার মূল্যায়ন হোক। তাই গ্রেস মার্কস না দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অর্জনটাই ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে। এটি খাঁটি ফলাফল।

একই কথা বললেন বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ইউনুস আলী সিদ্দিকীও। তিনি বলেন, এবার স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল— শিক্ষার প্রকৃত মান যাচাই করতে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া যাবে না। সেইল নির্দেশনা অনুসরণ করেই আমরা কঠোরভাবে পরীক্ষাটি পরিচালনা করেছি। ফলে এবার যে ফল এসেছে, সেটি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত করেছে।

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাকসুতে ৩৯ জন নির্বাচিত

‎পদ ফাঁকা থাকার বিষয়ে রাকসু, হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মো. সেতাউর রহমান বলেন, যে পদগুলো ফাঁকা আছে, সেগুলো ছাড়াই হল সংসদ চলবে। অন্য কোনোভাবে সেগুলো পূরণ করার উপায় নেই।

৬ ঘণ্টা আগে

জরুরি আরব-ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

দুই দিনব্যাপী জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তার সঙ্গে বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ছিলেন—অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব এম. ফরহাদুল ইসলাম, ওআইসিতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এম. জে. এইচ. জাবেদ এবং কাতারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হযরত আলী খান

১৮ ঘণ্টা আগে

‘নির্ধারিত ছয় মাসের আগেই নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্ত হবে’

জাতীয় বেতন কমিশনের চেয়ারম্যান জাকির আহমেদ খান বলেন, গত এক দশকে মূল্যস্ফীতি-জিডিপি বাড়লেও সে অনুপাতে বেতন বাড়েনি। একটি সময়োপযোগী বেতনকাঠামো নির্ধারণের পাশাপাশি কমিশন বিশেষায়িত চাকরির জন্য আলাদা বেতনকাঠামো গঠন; আয়কর পরিশোধ বিবেচনায় বেতনকাঠামো; বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও যাতায়াতসহ অন্যান্য ভাতা নিরূপণ; মূল্যস

১৯ ঘণ্টা আগে

পিএসসির নতুন সচিব আব্দুর রহমান

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গত ২৮ আগস্ট অবসরোত্তর ছুটিতে যান। ওই দিন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রহমান তরফদারকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে শ্রম সচিব নিয়োগ দেয় সরকার।

২০ ঘণ্টা আগে