কেবল নামেই সরকারি, ওষুধ-পরীক্ষা সবই বাইরের

প্রতিবেদক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ২০: ২৯

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশে বাড়ছে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব। ক্যান্সারের ধরন থেকে রোগীর সংখ্যা— সবকিছুর গ্রাফই ঊর্ধ্বমুখী। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসার সুযোগ কি বেড়েছে? ক্যান্সার শনাক্তের জন্য স্ক্রিনিং সেবা কি পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে প্রান্তিক এলাকায়? সরকারি হাসপাতালগুলোতে কি সুলভে মিলছে সেবা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রাজনীতি ডটকমের চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব পড়ুন এখানে—

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজি বিভাগ। অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের তুলনায় অনেকখানি পরিষ্কার, ছিমছাম। এতটা পরিষ্কার যে আদৌ সরকারি হাসপাতাল কি না, তা নিয়েই সন্দেহ হয়!

ভেতরে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা চারটি ওয়ার্ড। ওয়ার্ডগুলোও তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার। বাঁয়ের দুটি পুরুষ ওয়ার্ড, ডানের দুটি নারী। একটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে, কাঁথা গায়ে এক নারী শুয়ে আছেন। হাতে স্যালাইন চলছে। পাশে বসে ডালিমের দানা তুলছেন এক পুরুষ। কিছুক্ষণ পরপর চামচে করে মুখে তুলে দিচ্ছেন সেই ডালিমের দানা। কথা বলতে চাইলেই অনুরোধ— একটু খাইয়ে নিই?

খাওয়া শেষ হলে ওই নারীর মুখটা মুছে দিলেন মকবুল হোসেন। পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রেখে পেশায় বাবুর্চি তিনি। কাজ করেন মিরপুরে। আড়াই মাস ধরে থাকছেন হাসপাতালে। সে কারণে কাজও বন্ধ। এই আড়াই মাসে হাসপাতালের বিরুদ্ধে যেন অভিযোগের পাহাড় জমেছে মকবুল হোসেনের।

মকবুল জানাচ্ছেন, ছোট দুয়েকটা পরীক্ষা সরকারি এই হাসপাতালে করানো সম্ভব হলেও বড় সব পরীক্ষা তাকে করাতে হয়েছে বাইরে। প্রায় সব ওষুধই আনতে হয় বাইরে থেকে। হাসপাতালের খাবারের মান একেবারেই ভালো নয়। ভাত খাওয়ার উপযোগী নয়। তরকারি হলুদে ভরা। এমনকি পানি পর্যন্ত কিনে খেতে হয়।

রাজনীতি ডটকমকে মকবুল বলেন, “সরকারি হাসপাতাল হয়েও কোনো লাভ নাই। ওষুধ-পানি সবই বাইরে থেকে আনতে হয়। বাইরে থেকে সব টেস্ট করাইতে হয়। ‘মানি’ (টাকা) দিলে সব হয়। পানির মতো টাকা যাইতেছে কেবল। একটাই শান্তি, একটা বেড পাইছি।”

ক্যান্সার চিকিৎসা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব—

একই ওয়ার্ডে মাকে নিয়ে আছেন ফরিদপুরের রাহনুমা। তিনি বলেন, ‘কেমো শেষ। ওষুধ লিখে দিয়ে মাকে রিলিজ দিয়েছে। বাড়ি চলে যাব।’ তবে কতদিন বাড়ি থাকতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দিহান রাহনুমা। বলেন, ‘ছয় বছর ধরে এভাবেই দিন কাটছে আমাদের। হাসপাতালে ভর্তি হই, কেমো শেষ হয়, বাড়ি চলে যাই। আবার আসতে হয়।’

ছয় বছর আগে রাহনুমার মায়ের স্তন ক্যান্সার ধরার পড়ে। ফরিদপুর সদর হাসপাতালে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা না হওয়ায় ঢাকা আসতে হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালেও চিকিৎসা নিয়েছেন। এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। এই ছয় বছরে মায়ের চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর-ঢাকা-ফরিদপুর সময় কাটছে তাদের।

ঢামেক হাসপাতাল চিকিৎসা কেন হলো না— জানতে চাইলে রাহনুমা বলেন, ‘ওখানে বেড ফাঁকা ছিল না। ফ্লোরে রেখে মাকে চিকিৎসা করাতে চাইনি। এরপর এক পরিচিতের মাধ্যমে খোঁজ পেলাম, এখানে বেড ফাঁকা। তখন থেকে এই হাসপাতালেই চিকিৎসা নিচ্ছি। এখানকার পরিবেশ খুব ভালো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তো কয়েকগুণ বেশি।’

পরিচ্ছন্ন পরিবেশ পেলেও মকবুলের মতো রাহনুমারও অভিযোগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সব করাতে হয় বাইরে, ওষুধও কিনতে হয় বাইরে থেকে। রাহনুমা বলেন, ‘রক্তের সাধারণ কিছু টেস্ট হয় এখানে। ব্যথা আর বমির ওষুধ দেয়। আরও কিছু টেস্ট এখানে হয়তো করানো যায়, কিন্তু অনেক ঘুরতে হয়। অনেক সময় নষ্ট হয়। আবার ডাক্তাররা বলেন, যত দ্রুত টেস্ট করায়ে রিপোর্ট দেখানো যায়, ততই ভালো। কিন্তু এখানে টেস্ট করাতে গেলে যে ঘুরতে হয়, তাতে সময়মতো রোগীর চিকিৎসা আর হবে না। এ জন্য বাইরে থেকে করায়ে আনি। শুধু আমরা না, এখানে সবাইকেই তাই করতে হয়।’

হাসপাতালের বাকি ওয়ার্ডগুলো ঘুরেও একই চিত্র পাওয়া গেল। একজন রোগীকেও পাওয়া গেল না, যিনি সরকারি এই হাসপাতাল থেকে সব পরীক্ষা করাতে পারেন বা প্রয়োজনীয় সব ওষুধ পান। সবাই-ই পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন করান বাইরে, ওষুধও বাইরে থেকেই কিনে নিয়ে আসেন।

রোগী ও তাদের স্বজনরা বলছেন, সরকারি হাসপাতাল হিসেবে এখানে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের রোগীই বেশি। কিন্তু সরকারি নামটা যেন তাদের জন্য এক ধরনের ‘ফাঁদ’। কারণ হাসপাতালের নামটাই কেবল সরকারি, কিন্তু সব দামি পরীক্ষা যেমন বাইরে থেকে করাতে হয়, তেমনি দামি ওষুধও কিনে আনতে হয় বাইরে থেকে। তাতে কম খরচে সরকারি হাসপাতালের শয্যা পাওয়া ছাড়া সরকারি সেবার আর কোনো সুবিধাই পাওয়া সম্ভব হয় না।

ক্যান্সার চিকিৎসা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব—

দেশে প্রথম জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি থেকে জানা যায়, প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্ত ১১৪ জন। প্রতি লাখ জনগোষ্ঠীতে নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন আরও ৫৩ জন করে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যান্সারের চিকিৎসা এমনিতেই সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। বছরের পর বছর ধরে এর চিকিৎসা চালাতে গিয়ে অনেককেই নিঃস্ব হয়ে পড়তে হয়। অস্থাবর সম্পদ তো বটেই, ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয় অনেককে। সঙ্গে যুক্ত হয় ঋণের বোঝা। অনেককে চিকিৎসা বন্ধ পর্যন্ত করে দিতে হয় অর্থাভাবে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের যদি বাইরে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় এবং বাইরে থেকে ওষুধ কিনে খেতে হয়, সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

রোগীদের এমন অভিযোগ যে সত্যি, সেটি স্বীকার করে নিলেন হাসপাতালেরই একজন চিকিৎসক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘রোগীদের অভিযোগ শতভাগ সত্যি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না। তবে তারা (রোগী ও স্বজন) মিথ্যা বা অহেতুক কিছু বলেননি।’

দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা ও রোগী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল। রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে রাজধানীর ভেতরে খোদ সরকারি হাসপাতালেই রোগীরা হাসপাতাল থেকে সবকিছু পাচ্ছে না। অথচ একজন রোগী কোনো হাসপাতালে ভর্তি হলে তার পুরো দায়িত্ব হতে হবে সেই হাসপাতালের, সেটি সরকারি হাসপাতাল হোক বা বেসরকারি।’

অধ্যাপক ফয়সাল বলেন, ‘সরকারি হাসপাতাল হলে তো সেখানকার রোগীদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব হওয়ার কথা সরকারের। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে যাদের একেবারেই সামর্থ্য নেই, মূলত তারাই সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়। তারাও যদি হাসপাতাল থেকে সব ধরনের সেবা না পায়, তাহলে এই মানুষগুলো যাবে কোথায়?’

এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাফিউর রহমান রাজনীতি ডটকমের কাছে দাবি করলেন, তার হাসপাতালে এমন হওয়ার কথা নয়। তবুও তিনি খোঁজ নেবেন। হাসপাতালের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বা কারও যদি কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

আখতার গ্রুপে কাজের সুযোগ, পদসংখ্যা ১০

৮ ঘণ্টা আগে

আসিফ মাহমুদের হাতব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন, আলোচনায় কয়েকটি প্রশ্ন

তিনি বলেছেন, প্যাকিং করার সময় অস্ত্রসহ একটা ম্যাগাজিন রেখে আসলেও ভুলবশত আরেকটি ম্যাগাজিন ব্যাগেই রয়ে যায়। যেটা স্ক্যানে আসার পর আমার প্রোটোকল অফিসারের কাছে হস্তান্তর করে আসি। বিষয়টি সম্পূর্ণ আনইন্টেনশনাল। কিন্তু কোনো কারণে গুলি ভর্তি এই ম্যাগাজিন ‘ফাইনাল চেকিংয়েও’ ধরা না পড়লে- এ নিয়ে বড় সংকট তৈরি হত

৮ ঘণ্টা আগে

আসিফ মাহমুদের অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

এয়ারপোর্টে দুই দফা স্ক্যানিং করার পরও এটা ধরা পড়েনি। তৃতীয় দফায় গিয়ে এটি ধরা পড়েছে। এক্ষেত্রে এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ বিষয়ে কি বলবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এজন্য আমি অলরেডি বলেছি ধরেন আমার ভাই একজন নেতা। উনি যখন ঢোকে তখন অন্যদের থেকে একটু প্রিভিলেজ পায

৮ ঘণ্টা আগে

নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে মুখিয়ে আছে চীন : মির্জা ফখরুল

বিএনপির প্রতিনিধিদলের চীন সফর নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, সফরে এক চীন নীতির প্রতি বিএনপির দৃঢ় অবস্থানের কথা জানানো হয়েছে। তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের প্রয়োজন জানানোর পর চীন ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে। এ নিয়ে দেশটি প্রস্তাব দিলে ভবিষ্যতে ইতিবাচকভাবে দেখবে বিএনপি।

৮ ঘণ্টা আগে