শাহরিয়ার শরীফ
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত এসেছে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। ত্যাগ ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, তা শুধু ক্ষমতার রদবদল নয়, বরং রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের পথে এক নতুন যাত্রা। কিন্তু এই যাত্রার পথ মসৃণ নয়। রাজনৈতিক সংস্কার এবং নাগরিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দুর্নীতির ক্যানসার এখনো বিদ্যমান।
এই দুর্নীতি রোধ করা ও সংস্কারকে টেকসই করার বার্তা দিয়ে গেলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) চেয়ারম্যান ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ।
ঢাকায় তার প্রথম সফরের শেষ দিনে বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে ভ্যালেরিয়াঁ স্পষ্ট ভাষায় বলেন, কর্তৃত্ববাদ পতনের পরপরই দুর্নীতি গায়েব হয়ে যায় না। বরং এটি নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন রূপে টিকে থাকে। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে এবং এজন্য বৈশ্বিক সহযোগিতা, নাগরিক স্বাধীনতা ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা অপরিহার্য।
তিনি বলেন, গত বছর এ দেশে যে পরিবর্তন ঘটেছে তা প্রশংসনীয়। তবে সংস্কারের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখা না গেলে দুর্নীতি আবারও সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে গ্রাস করতে পারে।
ভ্যালেরিয়াঁর বক্তব্যে উঠে আসে সেই চিত্র— কর্তৃত্ববাদী আমলে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। শুধু দেশ নয়, বিশ্ব জুড়ে এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক হিসেবে প্রতিবছর প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পাচার হয়।
টিআই চেয়ারম্যানের মতে, এই অর্থ “দুর্নীতির বৈশ্বিক অর্থনীতি”কে বেগবান করছে। যে অর্থ জনস্বার্থে ব্যয় হয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য সৃষ্টি করতে পারত, তা রূপান্তরিত হচ্ছে অনুপার্জিত ব্যক্তিগত সম্পদে। এর ফলে অর্থনীতির ন্যায়সঙ্গত প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, যদি এই অর্থ পাচার না হতো, বাংলাদেশের জিডিপি আরও বৃদ্ধি পেত এবং তা দারিদ্র্য হ্রাসে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতো।
অর্থপাচার রোধে শুধু সরকার নয়, নাগরিক সমাজকেও আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান ভ্যালেরিয়াঁ। তার মতে, যারা অর্থলুটে জড়িত, তারা নানা আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুরক্ষার বলয়ে লুকিয়ে থাকে। এই আইনি সুরক্ষার নেপথ্যে কারা কাজ করছে, তা জানতে হবে। তারপর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থ প্রত্যার্পণের পথ তৈরি করতে হবে। তবে তিনি সতর্ক করেন, পাচার করা অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। বৈশ্বিক হিসেবে গড়ে পাচার করা অর্থের মাত্র ১ শতাংশই ফেরত আসে। তাই অগ্রাধিকার দিতে হবে পাচারের সুযোগ বন্ধ করায়।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ভ্যালেরিয়াঁ বলেন, টিআইবি সবসময় ক্ষমতাবানদের সমালোচনা করেছে, তাই সরকার পরিবর্তন হলেও তাদের অস্বস্তি কমবে না। আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর নতুন সরকারও টিআইবির ওয়াচডগ ভূমিকার কারণে অস্বস্তিতে পড়তে পারে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভ্যালেরিয়াঁর বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, গত ১৫ বছরে বিদেশি বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহায়তার মোট অঙ্কের দ্বিগুণেরও বেশি অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার হয়েছে। তার মতে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছিল এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি সহায়ক কাঠামোতে রূপ দেওয়া হয়েছিল। তিনি জোর দিয়ে বলেন, অর্থপাচার রোধে দুটি বিষয় জরুরি— প্রথমত, পাচারের সুযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করা; এবং দ্বিতীয়ত, ফেরত আনার প্রক্রিয়া জটিল হলেও তা চালিয়ে যাওয়া। তবে সবচেয়ে কার্যকর হলো পাচারের সুযোগ বন্ধ করা, কারণ ফেরত আনার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও অনিশ্চিত।
ভ্যালেরিয়াঁ মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। শুধু কর্তৃত্ববাদ পতন নয়, সেই শাসনের রেখে যাওয়া দুর্নীতি-প্রশ্রয়ী কাঠামো ভেঙে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে তোলা দরকার। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা যেমন অপরিহার্য, তেমনি প্রয়োজন শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। তিনি আশাবাদী যে বাংলাদেশ সরকার এই চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন এবং আন্তরিকভাবে সমাধান খুঁজছে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন, সংস্কার কার্যক্রম মাঝপথে থেমে গেলে অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
ভ্যালেরিয়াঁর বক্তব্য শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক দুর্নীতির জটিল বাস্তবতাকেই সামনে আনে। উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে অর্থ পাচার হয়ে উন্নত দেশে জমা হচ্ছে, এবং সেই অর্থ আবার বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বিকৃত করছে। এর ফলে দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে না, তারা তাদের নিজস্ব উন্নয়ন সম্ভাবনাও হারাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস টিআই চেয়ারম্যান ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়ানের সঙ্গে এক বৈঠকে বিষয়টির নতুন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। গত বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে তিনি বলেন, “শত শত কোটি ডলারের চুরি করা সম্পদ করস্বর্গ ও ধনী দেশে পাচার ঠেকাতে কঠোর আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো তৈরি করা জরুরি।”
প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, “অধিকাংশ সময় আমরা জানি এই চুরি করা অর্থ কোথা থেকে আসছে। তবুও এটিকে বৈধ অর্থ স্থানান্তর হিসেবে মেনে নেওয়া হয়, কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।”
প্রধান উপদেষ্টা জানান, বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে দক্ষিণের দেশগুলো থেকে চুরি করা সম্পদ পাচার ঠেকাতে। এ অর্থ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে করস্বর্গ ও উন্নত দেশে, যেখানে বিভিন্ন সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এগুলোর বৈধতা দিচ্ছে। তিনি বলেন, স্বৈরাচারের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ও আর্থিক নিয়ম-কানুনের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, এগুলো “লুট করা অর্থ অফশোর দ্বীপপুঞ্জ ও ধনী দেশগুলোতে জমা রাখা সহজ করে দেয়।”
টিআই চেয়ারম্যান ভ্যালেরিয়াঁ এ সময় চুরি করা সম্পদ উদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করেন, তবে যোগ করেন, “আমাদের আরও কঠোর আন্তর্জাতিক নিয়ম ও এর কার্যকর প্রয়োগ দরকার।”
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দ্বৈতনীতির সমালোচনা করে বলেন, তারা জেনেশুনে অবৈধ অর্থ জমা রাখছে। তিনি টিআইকে তাদের কণ্ঠস্বর আরও জোরালো করার এবং বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করে চুরি করা অর্থ পাচার বন্ধ করতে একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম গঠনে সহায়তা করার আহ্বান জানান।
টিআই বাংলাদেশের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান জানান, টিআইয়ের বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য শাখার যৌথ প্রচেষ্টায় শেখ হাসিনার সহযোগীদের অর্জিত সম্পত্তি জব্দ করা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদের পতন নতুন যাত্রার সূচনা করেছে। কিন্তু এই যাত্রা সফল করতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে আরও তীব্র করতে হবে। সংস্কার শুধু ঘোষণায় নয়, প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে টিকে থাকতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ। টিআই চেয়ারম্যানের বার্তা স্পষ্ট—কর্তৃত্ববাদ পতনের মাধ্যমে লড়াই শুরু হয়েছে, শেষ হয়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই লড়াই দীর্ঘমেয়াদি, এবং এর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করাই নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত এসেছে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। ত্যাগ ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, তা শুধু ক্ষমতার রদবদল নয়, বরং রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের পথে এক নতুন যাত্রা। কিন্তু এই যাত্রার পথ মসৃণ নয়। রাজনৈতিক সংস্কার এবং নাগরিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দুর্নীতির ক্যানসার এখনো বিদ্যমান।
এই দুর্নীতি রোধ করা ও সংস্কারকে টেকসই করার বার্তা দিয়ে গেলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) চেয়ারম্যান ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ।
ঢাকায় তার প্রথম সফরের শেষ দিনে বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে ভ্যালেরিয়াঁ স্পষ্ট ভাষায় বলেন, কর্তৃত্ববাদ পতনের পরপরই দুর্নীতি গায়েব হয়ে যায় না। বরং এটি নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন রূপে টিকে থাকে। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে এবং এজন্য বৈশ্বিক সহযোগিতা, নাগরিক স্বাধীনতা ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা অপরিহার্য।
তিনি বলেন, গত বছর এ দেশে যে পরিবর্তন ঘটেছে তা প্রশংসনীয়। তবে সংস্কারের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখা না গেলে দুর্নীতি আবারও সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে গ্রাস করতে পারে।
ভ্যালেরিয়াঁর বক্তব্যে উঠে আসে সেই চিত্র— কর্তৃত্ববাদী আমলে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। শুধু দেশ নয়, বিশ্ব জুড়ে এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক হিসেবে প্রতিবছর প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পাচার হয়।
টিআই চেয়ারম্যানের মতে, এই অর্থ “দুর্নীতির বৈশ্বিক অর্থনীতি”কে বেগবান করছে। যে অর্থ জনস্বার্থে ব্যয় হয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য সৃষ্টি করতে পারত, তা রূপান্তরিত হচ্ছে অনুপার্জিত ব্যক্তিগত সম্পদে। এর ফলে অর্থনীতির ন্যায়সঙ্গত প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, যদি এই অর্থ পাচার না হতো, বাংলাদেশের জিডিপি আরও বৃদ্ধি পেত এবং তা দারিদ্র্য হ্রাসে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতো।
অর্থপাচার রোধে শুধু সরকার নয়, নাগরিক সমাজকেও আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান ভ্যালেরিয়াঁ। তার মতে, যারা অর্থলুটে জড়িত, তারা নানা আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুরক্ষার বলয়ে লুকিয়ে থাকে। এই আইনি সুরক্ষার নেপথ্যে কারা কাজ করছে, তা জানতে হবে। তারপর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থ প্রত্যার্পণের পথ তৈরি করতে হবে। তবে তিনি সতর্ক করেন, পাচার করা অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। বৈশ্বিক হিসেবে গড়ে পাচার করা অর্থের মাত্র ১ শতাংশই ফেরত আসে। তাই অগ্রাধিকার দিতে হবে পাচারের সুযোগ বন্ধ করায়।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ভ্যালেরিয়াঁ বলেন, টিআইবি সবসময় ক্ষমতাবানদের সমালোচনা করেছে, তাই সরকার পরিবর্তন হলেও তাদের অস্বস্তি কমবে না। আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর নতুন সরকারও টিআইবির ওয়াচডগ ভূমিকার কারণে অস্বস্তিতে পড়তে পারে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভ্যালেরিয়াঁর বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, গত ১৫ বছরে বিদেশি বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহায়তার মোট অঙ্কের দ্বিগুণেরও বেশি অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার হয়েছে। তার মতে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছিল এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি সহায়ক কাঠামোতে রূপ দেওয়া হয়েছিল। তিনি জোর দিয়ে বলেন, অর্থপাচার রোধে দুটি বিষয় জরুরি— প্রথমত, পাচারের সুযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করা; এবং দ্বিতীয়ত, ফেরত আনার প্রক্রিয়া জটিল হলেও তা চালিয়ে যাওয়া। তবে সবচেয়ে কার্যকর হলো পাচারের সুযোগ বন্ধ করা, কারণ ফেরত আনার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও অনিশ্চিত।
ভ্যালেরিয়াঁ মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। শুধু কর্তৃত্ববাদ পতন নয়, সেই শাসনের রেখে যাওয়া দুর্নীতি-প্রশ্রয়ী কাঠামো ভেঙে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে তোলা দরকার। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা যেমন অপরিহার্য, তেমনি প্রয়োজন শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। তিনি আশাবাদী যে বাংলাদেশ সরকার এই চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন এবং আন্তরিকভাবে সমাধান খুঁজছে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন, সংস্কার কার্যক্রম মাঝপথে থেমে গেলে অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
ভ্যালেরিয়াঁর বক্তব্য শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক দুর্নীতির জটিল বাস্তবতাকেই সামনে আনে। উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে অর্থ পাচার হয়ে উন্নত দেশে জমা হচ্ছে, এবং সেই অর্থ আবার বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বিকৃত করছে। এর ফলে দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে না, তারা তাদের নিজস্ব উন্নয়ন সম্ভাবনাও হারাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস টিআই চেয়ারম্যান ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়ানের সঙ্গে এক বৈঠকে বিষয়টির নতুন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। গত বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে তিনি বলেন, “শত শত কোটি ডলারের চুরি করা সম্পদ করস্বর্গ ও ধনী দেশে পাচার ঠেকাতে কঠোর আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো তৈরি করা জরুরি।”
প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, “অধিকাংশ সময় আমরা জানি এই চুরি করা অর্থ কোথা থেকে আসছে। তবুও এটিকে বৈধ অর্থ স্থানান্তর হিসেবে মেনে নেওয়া হয়, কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।”
প্রধান উপদেষ্টা জানান, বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে দক্ষিণের দেশগুলো থেকে চুরি করা সম্পদ পাচার ঠেকাতে। এ অর্থ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে করস্বর্গ ও উন্নত দেশে, যেখানে বিভিন্ন সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এগুলোর বৈধতা দিচ্ছে। তিনি বলেন, স্বৈরাচারের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ও আর্থিক নিয়ম-কানুনের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, এগুলো “লুট করা অর্থ অফশোর দ্বীপপুঞ্জ ও ধনী দেশগুলোতে জমা রাখা সহজ করে দেয়।”
টিআই চেয়ারম্যান ভ্যালেরিয়াঁ এ সময় চুরি করা সম্পদ উদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করেন, তবে যোগ করেন, “আমাদের আরও কঠোর আন্তর্জাতিক নিয়ম ও এর কার্যকর প্রয়োগ দরকার।”
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দ্বৈতনীতির সমালোচনা করে বলেন, তারা জেনেশুনে অবৈধ অর্থ জমা রাখছে। তিনি টিআইকে তাদের কণ্ঠস্বর আরও জোরালো করার এবং বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করে চুরি করা অর্থ পাচার বন্ধ করতে একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম গঠনে সহায়তা করার আহ্বান জানান।
টিআই বাংলাদেশের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান জানান, টিআইয়ের বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য শাখার যৌথ প্রচেষ্টায় শেখ হাসিনার সহযোগীদের অর্জিত সম্পত্তি জব্দ করা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদের পতন নতুন যাত্রার সূচনা করেছে। কিন্তু এই যাত্রা সফল করতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে আরও তীব্র করতে হবে। সংস্কার শুধু ঘোষণায় নয়, প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে টিকে থাকতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ। টিআই চেয়ারম্যানের বার্তা স্পষ্ট—কর্তৃত্ববাদ পতনের মাধ্যমে লড়াই শুরু হয়েছে, শেষ হয়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই লড়াই দীর্ঘমেয়াদি, এবং এর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করাই নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
সভায় বিদ্যুৎ বিভাগের ‘বেসরকারি অংশগ্রহণে নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদন/বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা, ২০২৫’, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০২৫’ এবং আইন ও বিচার বিভাগের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (তৃতীয় সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-
১৭ ঘণ্টা আগে