বিচিত্র

এল নিনো ও লা নিনা : জলবায়ুর রহস্যময় দুই ছেলে

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০০: ৪৪

আমাদের পৃথিবীর আবহাওয়া সব সময় এক রকম থাকে না। কখনও খুব গরম পড়ে, কখনও টানা বৃষ্টি, আবার কখনও হঠাৎ করে ঠান্ডা। এসব পরিবর্তনের পেছনে অনেক কারণ থাকে। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো প্রশান্ত মহাসাগরের পানির তাপমাত্রা ও বাতাসের আচরণ। এই দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে তৈরি হয় দুটি আবহাওয়াগত অবস্থা—এল নিনো (El Niño) এবং লা নিনা (La Niña)। এগুলো এতটাই প্রভাব ফেলতে পারে যে, তা শুধু একটা দেশ নয়, পুরো পৃথিবীর আবহাওয়াকে বদলে দিতে পারে।

এল নিনো ও লা নিনা কী?

‘এল নিনো’ ও ‘লা নিনা’ এই দুটি শব্দ এসেছে স্প্যানিশ ভাষা থেকে। এল নিনো অর্থ ছোট ছেলে, আর লা নিনা অর্থ ছোট মেয়ে। তবে এই নামগুলো কেবল নামমাত্র নয়, এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রশান্ত মহাসাগরের পানির উষ্ণতা ও বাতাসের গতিপথ। এই দুটি অবস্থাই ঘটে নিরক্ষরেখার কাছাকাছি বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরে, যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা ও বাতাসের গতি একে অপরের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।

এল নিনো তখন ঘটে, যখন প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিকে পানি অস্বাভাবিকভাবে উষ্ণ হয়ে যায়। তখন বৃষ্টি, খরা ও তাপমাত্রা অনেক জায়গায় হঠাৎ বদলে যায়। আর লা নিনা হয় তখন, যখন সেই একই অঞ্চলের পানি অস্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা হয়।

এই ঘটনাগুলো প্রথম ধরা পড়ল কীভাবে?

১৬০০ সালের দিকে পেরুর জেলেরা লক্ষ্য করেছিল যে প্রতি বছর ডিসেম্বরে সমুদ্রের পানি হঠাৎ করে উষ্ণ হয়ে যায় এবং এতে করে মাছ কমে যায়। যেহেতু এই সময়টা ছিল ক্রিসমাসের কাছাকাছি, তারা এর নাম দেয় “এল নিনো”, যেটা যিশুখ্রিস্টকে বোঝাতেই ব্যবহৃত হতো।

এরপর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে, এই এল নিনো বা লা নিনা কেবল সমুদ্রেই নয়, বরং আবহাওয়াতেও বিশাল পরিবর্তন আনে। পরে এটি নিয়ে বিশদভাবে গবেষণা শুরু হয়।

ENSO চক্র কী?

এল নিনো ও লা নিনা মূলত একটি বড় আবহাওয়াগত প্রক্রিয়ার অংশ, যার নাম ENSO (El Niño Southern Oscillation)। এটি তিনটি পর্যায়ে দেখা যায়:

নিউট্রাল (সাধারণ) অবস্থায় – সমুদ্রের পানি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থাকে। বাতাস পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে বয়ে গিয়ে উষ্ণ পানি নিয়ে যায়। এতে স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টি ও তাপমাত্রা থাকে। এল নিনো পর্যায়ে – বাতাস দুর্বল হয়ে যায়। ফলে উষ্ণ পানি পূর্ব দিকে (পেরুর দিকে) জমে থাকে। এতে করে দক্ষিণ আমেরিকায় বেশি বৃষ্টি হয়, আর এশিয়ার অনেক দেশে খরা পড়ে।

লা নিনা পর্যায়ে – বাতাস আরও বেশি শক্তিশালী হয়। উষ্ণ পানি পশ্চিমে ঠেলে দেওয়া হয়, আর পূর্ব দিকে ঠান্ডা পানি উঠে আসে। এতে করে কিছু দেশে অতিবৃষ্টি হয়, আবার কোথাও তীব্র ঠান্ডা পড়ে।

এল নিনো ও লা নিনা কতদিন স্থায়ী হয়?

এই দুটি অবস্থাই সাধারণত ৯ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে কখনো কখনো এদের প্রভাব ২ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। সাধারণত ২ থেকে ৭ বছর পরপর এই চক্র ফিরে আসে। তবে কখন এল নিনো হবে আর কখন লা নিনা হবে, তা সঠিকভাবে আগেই বলা যায় না।

ইতিহাসে বড় বড় এল নিনো ও লা নিনা

১৯৮২-৮৩ সালের এল নিনো আমেরিকা থেকে চিলি পর্যন্ত ব্যাপক বন্যা ও ক্ষতি ঘটায়।

১৯৯৭-৯৮ সালের এল নিনো ছিল সবচেয়ে শক্তিশালীগুলোর একটি। এতে করে অনেক দেশে খরা, বন্যা, এবং দাবানল হয়।

১৯৮৮ সালের লা নিনা-র কারণে উত্তর আমেরিকায় মারাত্মক খরা পড়েছিল।

২০১৫-১৬ সালের এল নিনো ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম। তখন ইন্দোনেশিয়ায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল আর পেরুতে ব্যাপক বন্যা হয়েছিল।

এল নিনো ও লা নিনা কীভাবে আবহাওয়া বদলে দেয়?

এল নিনো চলাকালে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ও ইকুয়েডরে প্রচুর বৃষ্টি হয়, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় খরা পড়ে, আমেরিকার কিছু অংশে গরম শীত পড়ে। আটলান্টিকে হারিকেন কম হয়।

লা নিনা চলাকালে দক্ষিণ আমেরিকায় খরা হয়,অস্ট্রেলিয়াতে প্রচুর বৃষ্টি পড়ে, আমেরিকার দক্ষিণে শুষ্ক শীত পড়ে, আর উত্তরে ঠান্ডা এবং বরফ বেশি হয়। আটলান্টিকে হারিকেন বাড়ে।

এল নিনো ও লা নিনা কেন বিপজ্জনক?

এই দুটি অবস্থার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ বিপদে পড়ে। বিশেষ করে যেসব দেশ কৃষির উপর বেশি নির্ভর করে। খরা বা অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়, পানি সংকট দেখা দেয়, মানুষের জীবন কষ্টকর হয়ে পড়ে।

আফ্রিকার ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, নাইজার বা বাংলাদেশের মতো দেশে এল নিনোর কারণে বৃষ্টি কমে যায়, ফসল হয় না, মানুষ না খেয়ে থাকে। আবার অন্যদিকে ভিয়েতনাম বা থাইল্যান্ডে বন্যা বা লবণাক্ততার কারণে জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে এল নিনোর প্রভাব

বাংলাদেশেও এল নিনো ও লা নিনার প্রভাব পড়ে। এল নিনোর সময় বৃষ্টিপাত কমে যায়, খরা দেখা দেয়, ধান-গমসহ অনেক ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং পানির সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে যেসব বড় ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার অনেকগুলোই এল নিনো বা লা নিনা সময়ে ঘটেছিল। যেমন: ১৯৭০, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ছিল এল নিনো বছরের ঘটনা।

বিজ্ঞানীরা কী বলছেন?

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে এল নিনো ও লা নিনার মাত্রা ও সময় বেড়ে যাচ্ছে। আগে যেসব এল নিনো তুলনামূলক দুর্বল ছিল, এখন সেগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতে এল নিনো শুরু হলে সেটা আগের চেয়েও বেশি উষ্ণতা নিয়ে আসতে পারে। এতে করে ২০২৩ বা ২০২৪ সাল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গরম বছর হতে পারে।

আমাদের কী করণীয়?

জলবায়ু পরিবর্তন কমানোর জন্য গাছ লাগাতে হবে, জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন কয়লা, পেট্রোল, ডিজেলের ব্যবহার কমাতে হবে, পানি সংরক্ষণ করতে হবে এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে ক্ষতি কমানো যায়।

এল নিনো ও লা নিনা হচ্ছে প্রকৃতির জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দুটি চরিত্র। এদের প্রভাব শুধু আবহাওয়ায় নয়, বরং আমাদের জীবনযাত্রা, খাদ্য উৎপাদন ও অর্থনীতিতেও পড়ে। তাই এসব বিষয় সম্পর্কে জানা, সচেতন হওয়া এবং সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া এখন খুবই জরুরি।

লাইভ সায়েন্স

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে নিয়োগ, লাগবে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা

১২ ঘণ্টা আগে

‘জুলাই অভ্যুত্থান থেকে ডাকসু নির্বাচন পর্যন্ত ডুজা সাহসী ভূমিকা রেখেছে’

সাদিক কায়েম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ডাকসু নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ডুজা সাহসী ভূমিকা রেখেছে। আগামী দিনেও ডাকসুকে শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে সাংবাদিক সমিতির সহযোগিতা অপরিহার্য।

১২ ঘণ্টা আগে

মেঘনা ব্যাংকে কাজের সুযোগ, পদসংখ্যা ১২

১৩ ঘণ্টা আগে

প্রজ্ঞাপনের অপেক্ষায় বেরোবির ছাত্র সংসদ নির্বাচন: উপাচার্য

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখন রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী। তিনি বলেন, প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেই বেরোবিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া হবে।

১৪ ঘণ্টা আগে