গোপালগঞ্জে ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিহতদের দাফন নিয়ে প্রশ্ন

বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ০৯: ০৫
বুধবার গোপলগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে দিনভর সংঘর্ষে চারজন ও পরে চিকিৎসাধীর অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচি ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ঘটনার দিন যে চারজন মারা গেছেন, তাদের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়নি। সুরতহাল প্রতিবেদন বা ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাদের মরদেহ দাফন ও সৎকার নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

বুধবার (১৬ জুলাই) গোপালগঞ্জে দিনভর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী বিভিন্ন সংগঠন এবং ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। সেদিন রাতেই চারজন নিহতের তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়। পরে গুলিবিদ্ধ একজন শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

নিতহদের স্বজনদের অভিযোগ, ঘটনার দিন হাসপাতাল কিংবা প্রশাসন থেকে কোনো সহায়তা পাননি তারা। বাধ্য হয়েই ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ দাফন বা সৎকার করতে হয়েছে। তবে পুলিশের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, উচ্ছৃঙ্খল জনতার কারণে মরদেহগুলোর ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয়নি।

ময়নাতদন্ত করার আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ময়নাতদন্ত করা না হলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত বা অপরাধীদের সাজা দেওয়ার সুযোগটা কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশে পরেও কবর থেকে মরদেহ তুলে ময়নাতদন্তের সুযোগ আছে। তবে হিন্দু যে ব্যক্তিকে দাহ করা হয়েছে, তার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না।

সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, যদি পুলিশ বলে যে তাদের ময়নাতদন্ত করতে দেয়নি, তাহলে তারা এখন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করে মরদেহ উঠিয়ে পোস্টমর্টেম করতে পারে।

তবে গোপালগঞ্জের ঘটনায় এমন পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না, পুলিশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনো কিছু জানানো হয়নি। ঢামেকে শুক্রবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারানো ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা হবে কি না, সে বিষয়েও পুলিশের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

যা বলছে নিহতদের পরিবার

গোপালগঞ্জের নিহতদের একজন রমজান কাজী। তার বাবা কামরুল কাজী বলেন, আমার ছেলে কাজে গেছিল। কাজ থেকে আসার সময় সবাই দেখতে গেছিল, সেও গেছে। তার শরীরের এক পাশ দিয়ে বুলেট ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

সংঘর্ষের দিন একজনের নিথর দেহ ভ্যানে করে নিয়ে যেতে দেখা যায় কয়েকজনকে। চলন্ত ভ্যানটির পাশে আহাজারি করতে দেখা যায় নিহত রমজান কাজীর বাবা কামরুল কাজীকে। তার মামা কলিম মুন্সীও সঙ্গে ছিলেন।

কলিম মুন্সী বলেন, ঘটনার দিন রমজান আহত হওয়ার পর হাসপাতাল ও প্রশাসনের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ সহায়তা করেনি। কোনো দিক থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। না হাসপাতাল থেকে, না প্রশাসনের দিক দিয়ে। আমরা শেষে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করছি।

কলিম মুন্সীর দাবি, মরদেহের ময়নাতদন্ত না করার বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই তাদের বলেছিল। তিনি বলেন, হাসপাতালে যারা ছিল, তারা বলে যে ময়নাতদন্ত হবে না, লাশ নিয়ে চলে যাও। তারা আমাদের তাড়িঢে দিয়েছে।

গোপালগঞ্জের এ ঘটনায় যে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে আরেকজন সোহেল মোল্লা। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা সোহেল মোল্লার মা লাইলি বেগম। বাবা ইদ্রিস আলী জানালেন, ছেলের বুকে, কাঁধে ও পায়ে তিনটি আঘাতের চিহ্ন ছিল।

সোহেল মোল্লার স্ত্রী নিশি বেগম বলেন, আমার স্বামী ব্যবসা করতে কোনো অপরাধ করে নাই। কেন আমার স্বামীকে গুলি করল? মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনিও।

গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেশ বিশ্বাস অবশ্য দাবি করেছেন, পরিবারের সদস্যরাই ময়নাতদন্ত না করে মরদেহ নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত করে দেবো না কেন? যেটা পুলিশ কেস হয়, সেটা আমরা অবশ্যই করে দেই।

গোপালগঞ্জের ঘটনায় নিহতদের ময়নাতদন্তের বিষয়টি উঠে এসেছে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদনেও। সেখানে বলা হয়েছে, আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত চারজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত করতে না দিয়েই জেলা হাসপাতাল থেকে জোর করে নিয়ে যায়।

শুক্রবার ঢামেকে যার মৃত্যু হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. ফারুক বলেন, গোপালগঞ্জের ঘটনায় আহত একজন শুক্রবার মারা গেছেন। তার নাম রমজান মুন্সী। আরও দুজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তারা সবাই গুলিবিদ্ধ ছিলেন।

ময়নাতদন্তের বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া কী?

স্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরে কাউকে হত্যা করা হলে অপরাধের ধরন বা কীভাবে মৃত্যু হলো— এমন তথ্য পেতে মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। এই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরবর্তী সময়ে বিচারকাজের জন্য আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ৫ আগস্টের আগের অনেক ঘটনায় শোনা গেছে স্নাইপার রাইফেলে মারা গেছে। পুলিশের হাতে ছিল না। এখন যদি পোস্টমর্টেম হয় তাহলে বোঝা যাবে স্নইপার রাইফেলে মারা গেল কি না। তখন মৃত্যুগুলো পুলিশের হাতেই হয়েছিল কি না, সেটি বোঝা যাবে।

গোপালগঞ্জের ঘটনার প্রসঙ্গে এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, এখানেও বিষয়টি একই রকম। পুলিশের গুলিতে মারা গেল নাকি আর্মির গুলিতে মারা গেল— এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়ার জন্য ময়নাতদন্ত দরকার ছিল। ময়নাতদন্ত করা না হলে কাউকে অপরাধী হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে আইনে সাজা দেওয়ার সুযোগটা কমে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগেও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষের সময় ময়নাতদন্ত না করে অপরাধীদের পার পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তারা।

মনজিল মোরসেদ বলেন, রাজনৈতিক বিতর্ক কিংবা আলোচিত ঘটনার বিচার অনেক বছর পরও করার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ওই সময় যদি ময়নাতদন্ত করা নাও হয়, পরেও আদালতের নির্দেশ নিয়ে কবর থেকে মরহে তুলে নিয়ে ময়নাতদন্তত করার সুযোগ আছে।

গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত যাদের ময়নাতদন্ত করা হয়নি তাদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে— সে বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো কিছু জানানো হয়নি।

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

ঘনবসতিতে ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক ফ্লাইট কতটা নিরাপদ— প্রশ্ন নভোএয়ার এমডির

মফিজুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এ বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার ছিল যে চিরায়ত ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক ফ্লাইটগুলো এত ঘনবসতিপূর্ণ শহর থেকে পরিচালনা করা কতটা নিরাপদ। আমাদের কি এখনই বিকল্প কোনো স্থানে বিমান ঘাঁটি স্থানান্তরের কথা ভাবা উচিত নয়?

৪ ঘণ্টা আগে

বিমান বিধ্বস্তে প্রাণহানিতে নরেন্দ্র মোদির শোক

মোদি লিখেছেন, ঢাকায় মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় বহু তরুণ শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে গভীরভাবে মর্মাহত ও দুঃখিত। নিহতদের পরিবারের প্রতি আমাদের সমবেদনা। আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।

৪ ঘণ্টা আগে

শনাক্ত হলে দ্রুত হস্তান্তর করা হবে মরদেহ

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যাদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা যাবে না, তাদের মরদেহ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করে পরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

৫ ঘণ্টা আগে

বিমান বিধ্বস্তে নিহত বেড়ে ২০, আহত ১৭১: আইএসপিআর

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজের একটি ভবনের ওপর বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ জন। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আহতের সংখ্যা ১৭১ জন।

৫ ঘণ্টা আগে