নড়াইলে ১০ মাসে ২৭ খুন, ঘরছাড়া ৩৫০ পরিবার

কার্ত্তিক দাস, নড়াইল
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৫, ১২: ৪৬

নেই রাজনৈতিক হানাহানি কিংবা সংঘর্ষ। তবুও থেমে নেই হত্যাসহ ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু ভিলেজ পলিট্রিক্স। গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, গ্রাম্য দলাদলি, পূর্বশত্রুতাসহ এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নড়াইলে যত সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা। সংঘর্ষে কেউ মারা গেলে তখন চলে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ। গত ১৫ দিন সরেজমিন ঘুরে এমনটাই জানা গেছে।

পুলিশ ও এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১০ মাসে নড়াইল জেলায় ২৭টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আহত হয়েছে ৮০ জন। হামলা-মামলার ভয়ে গ্রামছাড়া প্রায় ৩৫০টি পরিবার। তারা ঈদে বাড়ি-ঘরে ফিরতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার এবং পূর্ব শত্রুতায় খুন হয়েছে ১৩ এবং অন্য কারণে খুন হয়েছে ১৪ জন। হত্যাকাণ্ডের পর শত্রুতায় ভাঙচুর ও আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে ৩৫০টির বেশি বাড়ি-দোকান। এ সময় ঘেরের মাছ, গবাদিপশু লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।

গত বছরের ২৯ অক্টোবর গরু চোর সন্দেহে নড়াইলের সদর উপজেলা তুলারামপুর ইউনিয়নের বেতেঙ্গা গ্রামে দুলাল ও জান্নাতুল শেখ নামে দুইজনকে, ২১ অক্টোবর ইতনা ইউনিয়নের চর-দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সবিতা রাণী বালা দুর্বৃত্তদের হাতে নিজ বাড়িতে খুন হন।

১৬ সেপ্টেম্বর সদরের বিছালী ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে ৪ বছরের রাশেদুলকে তার সৎমা রহিমা বেগম শ্বাসরোধে হত্যা করেন। ৯ সেপ্টেম্বর সদরের শেখাটি ইউনিয়নের কাইজদাহ গ্রামের শিমুল গাজীকে ঘরের মধ্যে হত্যা করে মাটি চাপা দেয় তারই স্ত্রী পলি বেগম। ৮ সেপ্টেম্বর পুরুলিয়া ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের কলেজ ছাত্র নাছিম শেখকে একই গ্রামের পাঞ্জা শেখের বাড়ির পাশ থেকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করেন।

পরে ৯ আগস্ট সদরের সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের বড়গাতি গ্রামের হাকিম মোল্যার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় চুনখোলা এলাকার চিত্রা নদী থেকে। ৫ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে নড়াইল জেলা কারাগারের পাশ থেকে শহরের বরাশোলা এলাকার নিষিদ্ধ যুবলীগ কর্মী মাজেদ খান দুবৃত্তের হাতে খুন হয়।

কালিয়া উপজেলার বাবলা-হাসলা ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রামের প্রভাবশালী মিলন মোল্যা ও আফতাব মোল্যা পক্ষের মধ্যে এলাকার আধিপত্য নিয়ে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এরই জেরে চলতি বছরের গত ১১ এপ্রিল দু’পক্ষের সংঘর্ষে আফতাব গ্রুপের ফরিদ মোল্যা খুন ও ১৫ জন আহত হয়। ১৮ দিন পর ২৯ এপ্রিল ফরিদ হত্যা মামলার ১৮ নম্বর আসামি রফিকুল মোল্যার মরদেহ এক প্রতিপক্ষের বাড়ির পিছন থেকে উদ্ধার করা হয়। দু’পক্ষের এ পাল্টাপাল্টি দ্বন্দ্ব-সংঘাতে এ পর্যন্ত প্রায় ২৫টি পরিবারের প্রায় ৫০টি বাড়ি ভাঙচুর-আগুনের পাশাপাশি মালামাল, ফসল, গবাদিপশু ও ঘেরের মাছ লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

ঈদুল ফিতরের আগের দিন ৩০ মার্চ কালিয়া উপজেলার পেড়লী ইউনিয়নের জামরিলডাঙ্গা গ্রামের লস্কর ও শেখ বংশের দ্বন্দ্বে দু’পক্ষের সংঘর্ষে তালেব শেখ খুন ও ১৫ জন আহত হন। ১৫ মার্চ হামিদপুর ইউনিয়নের সিলিমপুর গ্রামের হামিম মোল্যার সঙ্গে জনি মোল্যা গ্রুপের এলাকার আধিপত্যকে কেন্দ্র করে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে বিএনপি কর্মী জনি মোল্যা গ্রুপের হাসিম মোল্যা খুন ও ৮ জন আহত হয়।

১২ মার্চ জয়নগর ইউনিয়নের চরশুকতাইল গ্রামের আনসার জমাদ্দার ও হেকমত শেখের লোকজনের মধ্যে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে সৌদি প্রবাসী আকরাম শেখ খুন হয়। পুরুলিয়া ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের অমিয়ার মোল্যা গ্রুপের সঙ্গে শিরাফুল শেখ গ্রুপের এলাকার আধিপত্যে শিরাফুল গ্রুপের সুলতান মোল্যা খুন হয়। এ ঘটনায় আহত হয় ১০ জন।

লোহাগড়া উপজেলায় ১৪ মে ইতনা ইউনিয়নের কুমারডাঙ্গা গ্রামের এসকেন্দার শেখের সঙ্গে খাজা মোল্যার পূর্ব বিরোধের জেরে খাজা মোল্যা খুন হয়। এ সময় ১২টি মাছের ঘের, ২৫ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা ও ৪টি গরু লুট করা হয়।

৮ মে মল্লিকপুর ইউনিয়নের করফা গ্রামের কৃষক টোকন আলী পারিবারিক বিরোধের জেরে খুন এবং এ ঘটনায় আহত হয় ৪ জন। ৩১ মার্চ ঈদুল ফিতরের দিন লাহুড়িয়া ইউনিয়নের লাহুড়িয়া গ্রামের মনিরুল জমাদ্দার ও একই গ্রামের মিল্টন জমাদ্দার গ্রুপের মধ্যে পূর্ব শত্রুতার জেরে দু’পক্ষের সংঘর্ষে লাহুড়িয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবার শেখ নিহত ও আহত হয় ১৫ জন।

২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মল্লিকপুর ইউনিয়নের চর মল্লিকপুর গ্রামে লোহাগড়া উপজেলা যুবদলের সভাপতি মাহমুদ খান ও জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস শেখের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জেরে দু’পক্ষের সংঘর্ষে ইউনিয়ন বিএনপিকর্মী মিনারুল শেখ ও তার আপন ভাই জিয়ারুল শেখ খুন ও আহত হন ৭ জন।

১ আগস্ট লক্ষীপাশা ইউনিয়নের বয়রা গ্রামে পারভেজ কাজীর সাথে ইমদাদ কাজীর বিরোধের জেরে নয়ন শেখ খুন ও আহত হন ১ জন। ৯ মে উপজেলার নোয়াগ্রাম ইউনিয়নের শামুকখোলা গ্রামের খাজা খন্দকারের ছেলে যুবদল কর্মী সালমান খন্দকার স্থানীয় দ্বন্দ্বে খুন হন।

এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে আরো ১৪ জন খুনের শিকার হন। ৩০ মার্চ লোহাগড়ার লক্ষীপাশা বাজারে সবজি ক্রয়ের সময় কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে নড়াইল জেলা বাস-মিনিবাস ও মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ-আল-মামুনকে কাঁচামাল ব্যবসায়ী পিটিয়ে হত্যা করেন। ১২ মার্চ নোয়গ্রাম ইউনিয়নের চর-শামুকখোলা গ্রামে ৪ বছরের শাহাদাতের মরদেহ উদ্ধার হয়।

২৪ ডিসেম্বর সদরের মাইজপাড়া ইউপি মেম্বার বাসনা মল্লিক পরিষদের কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় দৌলতপুর গ্রামের রাজিবুল ইসলামসহ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। অভিযোগ, ধর্ষণ শেষে তার মুখে বিষ ঢেলে দেয়। এর ৩দিন পর বাসনা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।

১ ডিসেম্বর লোহাগড়ার মঙ্গলপুর গ্রামের বাক প্রতিবন্ধী ভ্যানচালক শওকত লস্করকে দুর্বৃত্তরা শ্বাসরোধ হত্যা করে ইজিভ্যান নিয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী ছালামাবাদ ইউনিয়নের বলাডাঙ্গা গ্রামে তার মরদেহ পাওয়া যায়। ১৪ নভেম্বর পারিবারিক বিরোধে খাসিয়াল ইউনিয়নের পাকুরিয়া গ্রামের ৬ বছরের হামিদার বাড়ির পাশ থেকে দু’হাত বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

নড়াইলের পুলিশ সুপার কাজী এহসানুল কবীর বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় নড়াইলে পুলিশের সংখ্যা নগণ্য। তারপরেও আমরা চেষ্টা করছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। প্রতিটি ইউনিয়নে, ওয়ার্ডে কাউন্সিলিং করছি। এসব ঘটনার বিস্তার যাতে না বাড়ে। পুলিশ এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং মানুষ যাতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে চেষ্টা করছে।

ad
ad

মাঠের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

যশোরের ‘সন্ত্রাসী’ পিচ্চি রাজা বেনাপোলে আটক

যশোরের রেলগেটপাড়ার সন্ত্রাসী হিসেবে স্বীকৃত পিচ্চি রাজা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে ধরা পড়েছে। এক যুগ ধরে যশোরে ভয়-ভীতি, হত্যা, ছিনতাই, মাদক ও অস্ত্র বাণিজ্যের মাধ্যমে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

৯ ঘণ্টা আগে

টাঙ্গাইলে ইউনিয়ন আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক গ্রেপ্তার

গ্রেপ্তার শফিকুল টিক্কা দিঘলকান্দি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কালিয়া গ্রামের মৃত শামছুল আলম খানের ছেলে। তিনি দিঘলকান্দি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য।

১০ ঘণ্টা আগে

ইজিবাইকে বৃদ্ধ দম্পতি, প্রাণ গেল বালিভর্তি ট্রলির চাপায়

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জাফর-মর্জিনা দম্পতি তাদের কালিয়ার বাড়ি থেকে ইজিবাইকে করে মহাজন এলাকায় আত্মীয়ের বাড়তে যাচ্ছিলেন। পথে তালবাড়িয়া এলাকায় বালুবাহী একটি ট্রলি ওই ইজিবাইককে চাপা দিলে তারা দুজনেই নিহত হন।

১০ ঘণ্টা আগে

টাঙ্গাইলে উদ্ধার সেই ১১ মর্টার শেল যমুনা নদীতে বিস্ফোরণ

ভূঞাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, বুধবার রাতে উপজেলার পাটিতাপাড়া এলাকার যমুনা নদীর তীর থেকে অবিস্ফোরিত ১১টি মর্টার শেল উদ্ধার করে সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল। পরে সেগুলো আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত নলিন এলাকার যমুনা নদীতে বিস্ফোরিত করা হয়েছে।

১৫ ঘণ্টা আগে