দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি টাস্কফোর্স দিয়ে সামাল দেয়া যাবে?

বিবিসি
নতুন করে ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার

দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে এবং দৈনন্দিন দরকারি পণ্যের দাম যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে সেজন্য বাজার তদারকি করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে সরকার, যা ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখা ও দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কার্যকর মেকানিজম বা কৌশল না থাকার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এ সমস্যার ‘স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী’ সমাধান টাস্কফোর্স দিয়ে সম্ভব হবে বলে মনে করেন না তারা।

তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্মসচিব মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম বলছেন, ‘সরকার এখন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এটাই এখন বড় সমস্যা। এর সমাধানে আরও পরিকল্পিতভাবে কাজ করতেই আমরা টাস্কফোর্সের প্রজ্ঞাপন জারি করেছি এবং তখন থেকেই এটা কার্যকর। এখন তারা (টাস্কফোর্স) নিজেরা বসে বাজার তদারকি করবেন।’

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভুঁইয়া বলছেন, বাজার পরিস্থিতি দেখে তাদের কাছে মনে হয়েছে যে দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

‘বর্ষা-বন্যার কারণে দাম হয়ত কিছুটা বাড়ত। কিন্তু যেভাবে বাড়ানো হয়েছে সেটা কারসাজি। আশা করছি টাস্কফোর্সের মনিটরিং শুরু হলে এর সুফল পাওয়া যাবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন হুমায়ুন কবির ভুঁইয়া।

যদিও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন বাজারের সংকট অনেক গভীর এবং ছোটখাটো যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে আপাতত কিছুটা লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে লাভ হবে না। ‘টাস্কফোর্স যদি জেলা পর্যায়ে কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুত আছে সেই তথ্য নিতে পারে। এটা করে মজুত রেখে মুনাফার চেষ্টা কিছুটা কমতে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

বাজার পরিস্থিতি আসলে কেমন

কিছু দিন ধরেই গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে ডিম আর কাঁচামরিচের দাম। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার আজ মঙ্গলবার সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির জন্য সাতটি প্রতিষ্ঠানকে সাময়িকভাবে অনুমতি দিয়েছে। এর আগে রোববার বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে এসেছে সাড়ে চার লাখ পিস ডিম।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিনই ডিমের চাহিদা দেশে প্রায় পাঁচ কোটি পিস। মঙ্গলবার কয়েকটি বাজারে এক ডজন ডিম ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

এছাড়া হুট করে ব্যাপক বেড়েছে কাঁচামরিচের দাম। মূলত সাম্প্রতিক বন্যা ও বর্ষার করণে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ার সুযোগে কাঁচামরিচের দাম অনেক বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাজার ভেদে এর কেজিপ্রতি দাম এখন ৫৫০-৫৮০ টাকা।

নিয়মিত বাজারে যান ঢাকার শান্তিনগর এলাকার লাবনী আক্তার। তার দাবি শাক সবজি থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে গত কয়েক দিনে। ‘একশ টাকার নিচে তরি-তরকারি কই?’ বলছিলেন তিনি।

বাড্ডা বাজারে মঙ্গলবার করল্লার পাইকারি দামই কেজিপ্রতি ৮০ টাকা দেখা গেছে। একজন ক্রেতা জানান চারদিন আগে যেই রসুন ছিল ২২০ টাকা, সেটি এখন ২৪০ টাকা আর ৭০ টাকার লাউ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়।

কারওয়ানবাজার থেকে পণ্য এনে রমনায় বিক্রি করেন দোকানি লিটন মিয়া। তার দাবি কারওয়ানবাজারের ‘পাইকারি বাজারেই দামে আগুন’ লেগেছে।

হুট করে দাম বাড়ল কেন

আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্মসচিব মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম বলেন, দাম কেন বাড়ল সেটি মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করেছে। তবে সেই পর্যালোচনায় কী বেরিয়ে এসেছে- সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।

তবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনা করে জানা গেছে সাধারণত বর্ষা মৌসুমে শাকসবজি কিংবা তরিতরকারির দাম একটু বাড়তির দিকে থাকে। এবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা।

এছাড়া যেসব পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে এই প্রক্রিয়াও খুব একটা কাজে আসছে না। এছাড়া গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পরপরই অনেক বাজারের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের হাতে। ফলে প্রথম কয়েকদিন কিছুটা বন্ধ থাকলেও এখন আবার চাঁদাবাজি ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে।

‘ডলারের উচ্চমূল্য, বর্ষা আর বন্যায় কৃষি উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি চাঁদাবাজিতো আছেই,’ বলছিলেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তার মতে, একটার পর একটা বন্যা আর বর্ষায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় অনেকে পণ্য মজুত করছে।

‘বাজারে বড় বড় পণ্যের সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণ করেন অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ী। তাদের কার্যক্রম ও সাপ্লাই দেখার পাশাপাশি খুচরা পর্যায় পর্যন্ত মনিটর করার মতো টুলস সরকারের হাতে নেই।’

অর্থাৎ এ মুহূর্তে বাজারে কী পরিমাণ চাল আছে বা সামনে কী পরিমাণ আসবে কিংবা মিলগুলোতে কী পরিমাণ আছে এর কোনো সমন্বিত তথ্য সরকারের কাছে নেই। একই অবস্থা আলু বা পিয়াজের মতো মজুত করে রাখা যায় এমন অন্য পণ্যেরও।

আর উৎপাদন, মজুত ও আমদানির যথাযথ পদ্ধতি বা ব্যবস্থা না থাকায় কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুত আছে সে সম্পর্কে সরকারের খুব একটা জানা নেই। এ কারণে বাজারে কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে কি না- সেটাও ধরা যায় না বলে মন্তব্য করেন মি. মোয়াজ্জেম।

ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভুঁইয়াও বলছেন পণ্যের বাজারে মূল নিয়ামক একদল ব্যবসায়ী। এর মধ্যে অসাধু কিছু ব্যবসায়ী দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

‘আমরা যখন বাজারে যাই তখন একরকম। আর বাজার থেকে চলে এলে আরেক রকম। চাঁদাবাজি কমেছে কিন্তু বন্ধ হয়নি। এখন টাস্কফোর্সের সাথে আমরাও কাজ করবো। আশা করি মনিটরিংটা ঠিক মতো হলে বাজারে প্রভাব পড়বে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

টাস্কফোর্স দিয়ে সামাল দেয়া যাবে?

সরকার টাস্কফোর্সের যে কার্যপরিধি নির্ধারণ করেছে তাতে বলা হয়েছে- টাস্কফোর্স নিয়মিত বিভিন্ন বাজার, বৃহৎ আড়ৎ/গোডাউন/কোল্ড স্টোরেজ ও সাপ্লাই চেইনের অন্যান্য স্থানগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার বিষয়টি তদারক করবে।

উৎপাদন, পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ের মধ্যে যাতে দামের পার্থক্য ন্যূনতম থাকে তা নিশ্চিত করবে ও সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবে তারা।

প্রতিটি জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত এ টাস্কফোর্স প্রতিদিনের মনিটরিং শেষে একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল এবং জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পাঠাবে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন টাস্কফোর্সকে প্রতিটি পণ্যের বিষয়ে আলাদা করে খোঁজ নিয়ে মনিটর করতে হবে। ‘তারা কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুদ আছে সেই তথ্য নেবেন। এটা করতে পারলে মজুত করে মুনাফার চেষ্টা কিছুটা হলেও কমবে,’ বলছিলেন তিনি।

তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ে এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে তিনি প্রাইস কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়ে বলেন এই কমিশনের কাছেই তথ্য থাকবে যে কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুদ আছে। এমনকি কে কোন পণ্য আমদানি করলো, কতটা বিক্রি করলো- এসব তথ্যও তাদের কাছে থাকবে।

ফলে কেউ যেমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারবে না, আবার বাজার সম্পর্কেও একটি পূর্ণ তথ্য সম্বলিত ধারণা সরকারের হাতে থাকবে। এগুলো না হলে দীর্ঘমেয়াদে টাস্কফোর্স নিয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভুঁইয়া বলছেন টাস্কফোর্স ঠিক মতো মনিটর করতে পারলে বাজারে তার প্রভাব পড়বে বলেই আশা করছেন তিনি।

ad
ad

অর্থের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

হেরিটেজ সুইটসের ৩য় শাখা বসুন্ধরা ‘ই’ ব্লকে

প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড হেরিটেজ সুইটসের তৃতীয় শাখা যাত্রা শুরু করল রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। বসুন্ধরার ‘ই’ ব্লকের ঢালী কাঁচাবাজার ও আশপাশের বাসিন্দাদের জন্য এ শাখা হবে ঐতিহ্য, স্বাদ ও আনন্দের মিলনস্থল।

৩ দিন আগে

জেট ফুয়েলের দাম আরো বাড়ল

রবিবার (৯ নভেম্বর) বিইআরসি সচিব মো. নজরুল ইসলাম সরকার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন দর নির্ধারণের বিষয়টি জানানো হয়েছে। যা কার্যকর হবে আগামীকাল ৯ নভেম্বর রাত ১২টা থেকে এবং পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

৪ দিন আগে

পে কমিশনের সিদ্ধান্ত আগামী সরকারের: অর্থ উপদেষ্টা

উপদেষ্টা বলেন, পে কমিশনের ব্যাপারটা আছে। এটা নিয়ে আমরা এখন কিছু বলতে পারি না। ওটা দেখা যাক কতদূর যায়। আমরা ইনিশিয়েট করে ফেলেছি। কিন্তু সেটা আগামী সরকার হয়তো করতে পারে।

৪ দিন আগে

৪-৫ দিনে দাম না কমলে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন: বাণিজ্য উপদেষ্টা

বাণিজ্য উপদেষ্টা পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন চেয়ে অনেকেই আবেদন দিয়ে রেখেছেন। বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এমন আবেদন রয়েছে দুই হাজার ৮০০টি।

৪ দিন আগে