পুঁজিবাজার

এনবিআরের চিঠি প্রত্যাহার জরুরি

ফজলুল বারী

দেশীয় পুঁজিবাজার ফের ঋণাত্মক ধারায়। এটি আরোপিত মন্দা, অন্তর্ঘাত চেষ্টা! জড়িতরা বাজার ব্যবস্থাপনার সাথেই মিলেমিশে আছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) নীতি নির্ধারকরাও এর সঙ্গে যুক্ত। জড়িতদের প্রায় সবাই পলাতক শেখ হাসিনার দোসর। তারা পুঁজিবাজারসহ বাংলাদেশের সব সম্ভাবনার জায়গাগুলোতে অসম্ভব করার মিশনে যুক্ত।

তারাই উড়ন্ত ধনাত্মক পুঁজিবাজারকে ঋণাত্মক পরিণতি দিয়েছে। মদত দিচ্ছে মাঠের আন্দোলন ও অন্তর্ঘাত প্রয়াসকেও। বাস্তবতা হলো— উড়ন্ত পুঁজিবাজার সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করে।

মাফিয়া সরকারের দেড় দশক পর ক্ষমতায় আসে ড. ইউনূস সরকার। শুরুতে পুঁজিবাজারে ধনাত্মক প্রবাহ ধরা দেয়। বিষয়জ্ঞানবিবর্জিত নতুন চেয়ারম্যান বাজারে আতঙ্ক ছড়ান। পরে বিএসইসিতে নিয়োগ পান প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তার কয়েকটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বাজার সংশ্লিষ্টদের আস্থা অর্জন করে।

একই সঙ্গে ম্যাক্রো ইকোনমির কয়েকটি সূচকও সবুজ সংকেত দিতে শুরু করে। রাজনীতি হয় নির্বাচনমুখী। তাতেই কাজ হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে নতুন অর্থ পুঁজিবাজারে প্রবেশ করতে থাকে। মূল্য সূচক ও লেনদেন অঙ্কও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্য সূচক ৫৬০০ পয়েন্টের উচ্চতায় উঠে। দিনের লেনদেন অঙ্ক বেড়ে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঘরে উন্নীত হয়।

সহ্য হয়নি বিনিয়োগ শত্রুদের। তাদের অবস্থান পুঁজিবাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্তাদের মধ্যেই, প্রশাসনের বিভিন্ন স্থানেও। তাদের অনেকেই পলাতক মাফিয়া লুটেরা সরকারের দোসর। তারাই ধনাত্মক পুঁজিবাজারে ঋণাত্মক পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে।

শুরুতে ‘প্রফিট টেকিং মোড়ক’ জড়ানো হয়। পরে থলের বিড়াল বের হতে থাকে। বিএসইসি, ডিএসই, বিবি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উড়ন্ত পুঁজিবাজারের ডানা ছাঁটতে শুরু করে। বিএসইসি ফের জরিমানা কার্যক্রম চালু করে! একই সঙ্গে বিভিন্ন ব্রোকার হাউজে বিশেষ অডিট টিমের মোড়কে হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে।

ডিএসই কর্মকর্তারা বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে খবর পাঠাতে শুরু করে। কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীর বিস্তারিত তথ্য জানতে চায়। শেয়ারের দাম বাড়লেই তাৎক্ষণিকভাবে কারণ জানাতে চিঠি পাঠাতে শুরু করে। দাম কমলে হাত গুটিয়ে বসে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুযোগ-সুবিধা দিতে শুরু করে। এর বিপরীতে বিনিয়োগ স্বার্থ উপেক্ষা করে একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে থাকে ব্যাংকগুলোতে। সুশীল গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুর ঘোষণা দেন—পুঁজিবাজারের স্বার্থ দেখা তার কাজ নয়!

সবকিছু বাদ দিলেও এটা তো ঠিক, বাংলাদেশের ৬২টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ৩৬টি ব্যাংকই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। বিনিয়োগকারীর সংখ্যা লাখো অঙ্কের। এ অবস্থায় বিবি গভর্নর কীভাবে তিনি দায় এড়াবেন? বলতে পারেন?

পতনের মাস্টারস্ট্রোক ছিল গত সপ্তাহে পাঠানো এনবিআরের একটি চিঠি! সে চিঠিতে বলা হয়— ‘৫০ লাখ টাকা বা তার অধিক মূলধনী আয় প্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রেরণ করতে হবে।’ সঙ্গে ছকও যুক্ত করা হয়। সংযুক্ত ছক অনুযায়ী তথ্য পাঠাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

প্রকৃতপক্ষে এনবিআর ছোট ও মাঝারি আয়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যমদূত। এ প্রতিষ্ঠানটি সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর কাছ থেকেও কর আদায় করে। মৃত ব্যক্তির মরণ প্রক্রিয়ার শুরু থেকে দাফন/শেষকৃত্য পর্যন্ত কর আদায় করতেই থাকে। যাদের কর সমন্বয়ের সুযোগ নেই তাদের গাড়ি নবায়ন ফি পাঁচ হাজার টাকা প্রদানের সময় অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা (১৫০০ সিসির গাড়ি) আগাম ‘ফি’ আদায় করে।

পুঁজিবাজারের প্রতিটি বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে কমপক্ষে তিনবার ‘কর’ আদায় করে। এনবিআরের নীতি হলো— কর খাতে নাম যুক্ত হওয়া ব্যক্তির আয় থাক বা না থাক, কর তোমায় দিতেই হবে। অন্যদিকে যারা কর ফাঁকি দেয়, টাকা পাচার করে, তারা বারবার অতিরিক্ত সুবিধা ও মর্যাদা পেতে থাকে।

উল্লিখিত নীতি অনুসরণ করেই শেষোক্ত চিঠিটি প্রদান করা হয় পুঁজিবাজারে। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো— চিঠি প্রদানের আগে তারা কি খোঁজ নিয়েছে কতজন বিনিয়োগকারী কত টাকা লোকসানে আছে? কতগুলো অ্যাকাউন্ট ‘ইকুইটি মাইনাসে’ আছে? পুঞ্জিভূত লোকসান ওঠাতে মূল্য সূচক কোন অবস্থানে উন্নীত হতে হবে?

বাস্তবতা হলো— বর্তমান সূচক অবস্থানে কোনো ব্যক্তি অথবা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্টই মুনাফাতে নেই। যদি থাকে, সেটা ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে। পোর্টফোলিও মুনাফায় না ফিরলে মূলধনী আয় হিসেব হবে কীভাবে?

পুঁজিবাজার স্পর্শকাতর, বিশেষায়িত খাত। বিষয়জ্ঞানবিবর্জিতদের পুঁজিবাজারের ত্রিসীমানায় ঢোকা নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। উল্লিখিত বাস্তবতায় প্রদত্ত চিঠি অবশ্যই অন্তর্ঘাত-সহায়ক ও বিনিয়োগ-বিনাশী! অবিলম্বে প্রদত্ত চিঠি প্রত্যাহার করা জরুরি।

প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সপ্তাহে ডিএসইর চারটির মধ্যে তিনটি মূল্য সূচকই হ্রাস পায়। ডিএসইএক্স, ডিএসই-৩০, ডিএসই শরিয়াহ সূচক হ্রাস পায় যথাক্রমে ৭২ দশমিক ৮৫, ৪৩ দশমিক ৯৪ ও ১৮ দশমিক ১১ পয়েন্ট। এসএমই সূচক বাড়ে ৪৬ দশমিক ১ পয়েন্ট।

খাতভিত্তিক পরিসংখ্যান হলো— গত সপ্তাহে ডিএসইতে ২১টির মধ্যে ২০ খাতের শেয়ারেরই দরপতন ঘটে। লেনদেন বিবেচনায় ২১ খাতের মধ্যে ২০ খাতের শেয়ারেই লাল সংকেত প্রদর্শিত হয়। শুধু একটি খাতে সবুজ সংকেত দেখা গেছে।

ডিএসইর মার্কেট পিই অনুপাত ১০ দশমিক ৫। ২০ পিই অনুপাতের নিচে ১৫ খাতের সিকিউরিটিজ। ছয়টির পিই অনুপাত ২০-এর ওপরে। সার্বিক বাজার চিত্র ক্রয়-অনুকূল। কিন্তু বাজারে ক্রেতার অভাব প্রকট।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক

ad
ad

অর্থের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

গ্লোবাল ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যাওয়ার্ড পেল ইসলামী ব্যাংক

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীম এ সামিটের উদ্বোধন করেন এবং মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ড. আহমেদ জাহিদ হামিদিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের র্ঊধ্বতন নির্বাহী, র্কমর্কতা এবং বিভিন্ন দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। জিফা অ্যাওয়ার

৫ দিন আগে

সিটি ব্রোকারেজকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ দেবে আইসিবি

আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ, সিটি ব্রোকারেজের এমডি ও সিইও এম আফফান ইউছুফ এবং সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক-সিএফও ও সিটি ব্রোকারেজের পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান চুক্তিতে সই করেছেন।

৫ দিন আগে

পদত্যাগ করলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখপাত্র

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চাপের মুখে পড়েন এই সাবেক মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, দুই ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ প্রধান ও নীতি উপদেষ্টা পদত্যাগে বাধ্য হন। তারা সবাই চুক্তিভিত্তিক কর্মরত ছিলেন। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পট পর

৫ দিন আগে

৫ ব্যাংক চূড়ান্তভাবে একীভূত হচ্ছে, বসছে প্রশাসক

সমস্যাগ্রস্ত পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করে নতুন একটি ব্যাংক গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

৫ দিন আগে