মোরাল— ব্যাংকিং স্থিতিস্থাপকতা ও সাফল্যের অদৃশ্য স্তম্ভ

যে শিল্প মূলধন পর্যাপ্ততা, তারল্য নীতিমালা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ দ্বারা পরিচালিত, সেখানে একটি অদৃশ্য সম্পদ প্রায়ই অবমূল্যায়িত হয়— ‘কর্মী মোরাল’। এটি কোনো সাধারণ ‘সফট’ মেট্রিক নয়, বরং একটি কৌশলগত সুবিধা, যা আর্থিক স্থিতিশীলতা, গ্রাহক আস্থা, কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতামূলক শক্তি সরাসরি প্রভাবিত করে।

এই বিশ্লেষণে সংগঠন তত্ত্ব, আচরণগত অর্থনীতি ও ব্যাংকিংয়ের সেরা চর্চাগুলোকে একত্রিত করে দেখানো হয়েছে যে মোরাল কেন টায়ার-১ মানবসম্পদ, যা একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের অপরিহার্য ভিত্তি।

মনে রাখতে হবে, এটি একটি ধারণাগত আলোচনা এবং এটি আর্থিক, আইনি বা নিয়ন্ত্রক পরামর্শ নয়। এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব, যা সিটি ব্যাংক পিএলসি, বাংলাদেশ ব্যাংক বা কোনো অনুমোদিত নিয়ন্ত্রক সংস্থার আনুষ্ঠানিক নীতি বা অবস্থানেরনকে প্রতিফলন নয়। রিস্ক ফ্রেমওয়ার্ক, কমপ্লায়েন্স স্ট্যান্ডার্ড বা কৌশলগত সুপারিশের সব ব্যাখ্যা প্রকল্পিত, যা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত অংশীজনদের দ্বারা যাচাই করা আবশ্যক।

ভূমিকা: ব্যাংকিং শ্রেষ্ঠত্বের মানবিক দিক

ব্যাংকিংয়ের সাফল্য দীর্ঘকাল ধরে ব্যালেন্স শিট ও নিয়ন্ত্রক অনুপাত দ্বারা পরিমাপ করা হয়েছে। কিন্তু এই সংখ্যাগুলোর নিচে একটি অপরিমেয় শক্তি রয়েছে— কর্মীদের সম্মিলিত মোরাল। অর্থনৈতিক চাপ, ডিজিটাল পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রক তদন্তের সময়, মোরালই নির্ধারণ করে একটি প্রতিষ্ঠান স্থিতিস্থাপকতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাবে, নাকি চাপে ভেঙে পড়বে।

উচ্চ মোরাল সক্রিয় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, গ্রাহককেন্দ্রিক উদ্ভাবন ও অভিযোজিত সিদ্ধান্তকে শক্তি দেয়। অবনত মোরাল অপারেশনাল দুর্বলতা, সুনামগত ঝুঁকি ও কৌশলগত জড়তা তৈরি করে। এটি অনুমানভিত্তিক নয়, বরং সেসব প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষণযোগ্য, যারা শুধু মূলধন বাফার নয়, সাংস্কৃতিক সংহতি দিয়ে সংকট মোকাবিলা করেছে।

ব্যাংকগুলোর জন্য ‘মোরাল’ কোনো এইচআর বিষয় নয়। এটি একটি মূল ঝুঁকি প্রশমন ও কর্মদক্ষতা ত্বরান্বিতকারী উপাদান।

‘সংস্কৃতি কৌশলকে নাস্তানাবুদ করে দেয়।’— পিটার ড্রাকার

কৌশলগত সম্পদ হিসাবে মোরাল: ৪টি প্রভাব স্তম্ভ

অপারেশনাল স্থিতিস্থাপকতা: মানবিক সার্কিট ব্রেকার

পরিস্থিতি: সাইবার আক্রমণ, তারল্য সংকট বা নিয়ন্ত্রক অডিট।

মোরালের ভূমিকা: উচ্চ মোরালসম্পন্ন দল ক্রস-ফাংশনাল সহযোগিতা, দ্রুত সমস্যা সমাধান ও সংকটকালে অতিরিক্ত প্রচেষ্টা প্রদর্শন করে। নিম্ন মোরাল প্রক্রিয়াগত ক্লান্তি, বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত ও অপারেশনাল ঝুঁকি বাড়ায়।

নিয়ন্ত্রক সঙ্গতি: ব্যাসেল III/IV অপারেশনাল ধারাবাহিকতা জোর দেয়, মোরাল এটি বজায় রাখে। সাইকোলজিক্যাল সেফটি ইনডেক্স (পিএসআই) রিস্ক কালচারের একটি সূচক হিসাবে নিয়ন্ত্রক কাঠামোতে স্বীকৃতি পাচ্ছে।

গ্রাহক আস্থা: আবেগের হিসাব

পরিস্থিতি: সুদের হার ওঠানামা, সেবা বিলম্ব বা সুনামগত সংকট।

মোরালের ভূমিকা: নিবেদিত কর্মীরা সহানুভূতি, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা দিয়ে আস্থা পুনর্গঠন করে। বিচ্ছিন্ন কর্মীরা ভুল যোগাযোগ বা উদাসীনতা দিয়ে গ্রাহক হারানোর ঝুঁকি বাড়ায়।

ব্যবসায়িক প্রয়োজনীয়তা: আস্থা একটি ব্যাংকের সবচেয়ে ভঙ্গুর আমানত—একবার হারালে ফিরে পাওয়া ব্যয়বহুল।

ঝুঁকি সংস্কৃতি: নৈতিক মেরুদণ্ড

পরিস্থিতি: এএমএল লঙ্ঘন, জালিয়াতি বা কমপ্লায়েন্স ব্যর্থতা।

মোরালের ভূমিকা: মূল্যবান ও শোনার অনুভূতি থাকলে কর্মীরা অনিয়ম রিপোর্ট করে ও নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে। দুর্বল মোরাল নীরবতা, শর্টকাট বা গোপনীয়তা তৈরি করে, অনৈতিক আচরণের পূর্বসূরী।

কমপ্লায়েন্স সংযোগ: বাংলাদেশ ব্যাংকের করপোরেট গভর্ন্যান্স নির্দেশিকা পরোক্ষভাবে ঝুঁকি সংস্কৃতিকে কর্মী কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করেছে।

উদ্ভাবন: পরিবর্তনের প্রভাবক

পরিস্থিতি: ডিজিটাল রূপান্তর, বাজার সম্প্রসারণ বা প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণ।

মোরালের ভূমিকা: উচ্চ মোরাল পরিবর্তন গ্রহণ ও পরীক্ষামূলক কাজে উদ্দীপনা জোগায়। নিম্ন মোরাল প্রতিরোধ তৈরি করে, কৌশলগত বিনিয়োগের রিটার্ন বিলম্বিত করে।

কৌশলগত অন্তর্দৃষ্টি: তথ্য বলছে, ৭০ শতাংশ রূপান্তর ব্যর্থ হয় প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে নয়, সাংস্কৃতিক অসামঞ্জস্যের কারণে।

মোরাল সম্পদ গঠন: নেতৃত্বের কাঠামো

মোরাল দৈবক্রমে নয়, পরিকল্পিতভাবে গঠন করতে হয়। মূল চালিকাশক্তিগুলো হলো—

চালিকা শক্তিকার্যকর পদক্ষেপপ্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা
উদ্দেশ্যমূলক নেতৃত্বদৈনন্দিন কাজকে উচ্চতর লক্ষ্যের (যেমন আর্থিক অন্তর্ভুক্তি) সঙ্গে যুক্ত করুনটার্নওভার কমায়; অতিরিক্ত প্রচেষ্টা বাড়ে
মানসিক নিরাপত্তামুক্ত মতামত দেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করুন (রিস্ক টিমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ)ঝুঁকি শনাক্তকরণের প্রাথমিক ব্যবস্থা
ন্যায্য স্বীকৃতিপুরস্কার পরিমাপযোগ্য আচরণের সঙ্গে যুক্ত করুন (শুধু ফলাফল নয়)‘টক্সিক স্টার পারফর্মার’ ঝুঁকি হ্রাস
ভবিষ্যত-প্রস্তুত দক্ষতাএআই-সহায়ক ভূমিকার জন্য প্রশিক্ষণ দিন (শুধু অটোমেশন নয়)ডিজিটাল পরিবর্তনে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান রক্ষা
স্বচ্ছ যোগাযোগসংকটকালীন বার্তা (যেমন ‘আমাদের পরিকল্পনা’) দিয়ে গুজব নিয়ন্ত্রণ করুনস্টেকহোল্ডার আস্থা বজায় রাখে

উপেক্ষার মূল্য: অবনতির পরিমাপ

মোরাল উপেক্ষা করলে সুনির্দিষ্ট আর্থিক ও নিয়ন্ত্রক পরিণতি দেখা দেয়।

অপারেশনাল ঝুঁকি বৃদ্ধি: FATF রিপোর্ট অনুযায়ী, নিম্ন মোরাল এএমএল ত্রুটি বাড়ায়।

সুনামগত ক্ষতি: গ্লাসডোর ও সোশ্যাল মিডিয়া কর্মী অসন্তোষ ছড়িয়ে দেয়, যা দক্ষতা ও গ্রাহক আকর্ষণে বাধা দেয়।

কৌশলগত স্থবিরতা: দুর্বল মোরালসম্পন্ন ব্যাংকগুলো ডিজিটাল পরিপক্বতায় পিছিয়ে থাকে (অ্যাকসেনচার, ২০২৪)। উদাহরণ: একটি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সিস্টেম পরিবর্তন ব্যর্থ হয়েছিল প্রযুক্তির কারণে নয়, পরিবর্তন ক্লান্তি ও নীরব অনাগ্রহের কারণে।

উপসংহার: অদৃশ্যকে পরিমাপ, অপরিহার্যকে পরিচালনা

মোরাল আইএফআরএস ব্যালেন্স শিটে ধরা না পড়লেও এর প্রভাব পরিমাপযোগ্য। ইএনপিএস (কর্মী নেট প্রমোটার স্কোর), রিস্ক নিয়ার-মিস রিপোর্টিং হার, কর্মী আচরণ-সংযুক্ত গ্রাহক অভিযোগ।

সি-স্যুট নেতাদের জন্য মোরাল কল্যাণমূলক বিষয় নয়। এটি একটি ফিডুশিয়ারি ও কৌশলগত অগ্রাধিকার। যে যুগে মানব ও ডিজিটাল সম্পদ একত্রিত হচ্ছে, মোরালে বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলো শুধু আর্থিকভাবে নয়, নিয়ন্ত্রক সমর্থন, গ্রাহক আনুগত্য ও পদ্ধতিগত স্থিতিস্থাপকতায় এগিয়ে থাকবে।

লেখক: কোম্পানি সচিব, সিটি ব্যাংক পিএলসি

ad
ad

অর্থের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

চাঁদপুরে জনতা ব্যাংকের ব্যবসায়িক শাখা ব্যবস্থাপক সম্মেলন

চাঁদপুর এরিয়া অফিসের জিজিএম জি. এম. নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে এরিয়া অফিসের আওতাধীন সংশ্লিষ্ট নির্বাহী এবং শাখা ব্যবস্থাপকবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।

৩ দিন আগে

আগস্টে সাড়ে ২৯ হাজার কোটি টাকার প্রবাসী আয়

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্টে) মোট ৪৯০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এর টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫৯ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, গত অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৭৬ কোটি ২০ লা

৪ দিন আগে

নতুন পুঁজি প্রবেশে আশাবাদ, শঙ্কা ‘মার্জিন ক্যাসিনো’

বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) অর্থবাজারের শীর্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান। বিবি গভর্নর বহুদিন থেকেই পুঁজিবাজারবিরোধী প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছেন। তার ব্যাংক ব্যবস্থাপনা নীতি, বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারী-বিকর্ষক। তিনি জনগণের টাকায় একটি বিশেষ শ্রেণিকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হয়।

৫ দিন আগে

পটুয়াখালী ইপিজেড দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে বিপ্লব আনবে, হবে ৩ লাখ কর্মসংস্থান

এই ইপিজেড গড়ে তুলতে মোট খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৪৪২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার ১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা দেবে, যার ৪০ শতাংশই মূলধনী বিনিয়োগ। বাকি প্রায় ৩৩৮ কোটি টাকা আসবে বেপজার নিজস্ব তহবিল থেকে। আয়তনের দিক থেকে এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইপিজেড।

৭ দিন আগে