বিজ্ঞান

যুদ্ধে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
আপডেট : ১০ মে ২০২৫, ১৮: ৫৪

আধুনিক যুদ্ধে এখন শুধু স্থলভাগে সেনা পাঠালেই হয় না। যুদ্ধ এখন চলে আকাশে, মাটির নিচে, এমনকি সাইবার দুনিয়ায়ও। শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন বা যুদ্ধবিমান যখন কোনো দেশের দিকে ধেয়ে আসে, তখন তাকে ঠেকাতে কাজে লাগে যাকে বলে “আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা”। কিন্তু এই ব্যবস্থা আসলে কীভাবে কাজ করে? এর ভেতরের প্রযুক্তি কতটা উন্নত? আর বিশ্বে কোন কোন দেশ এই প্রযুক্তিতে অগ্রগামী? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমরা একবার ঘুরে এলাম যুদ্ধের আকাশ প্রতিরক্ষার অজানা জগতে।

আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আসলে কী?

সহজভাবে বললে, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হলো এমন এক প্রযুক্তিগত কৌশল, যা শত্রুর আকাশপথে চালানো আক্রমণ যেমন—বিমান, হেলিকপ্টার, ড্রোন, ক্রুজ মিসাইল বা ব্যালিস্টিক মিসাইল—আসার আগেই শনাক্ত করে এবং ধ্বংস করে দেয়। একে অনেকটা "আকাশের ঢাল" বলা যেতে পারে। এই প্রযুক্তির পেছনে আছে অত্যাধুনিক রাডার, ইলেকট্রনিক সেন্সর, দ্রুতগামী প্রতিরক্ষা মিসাইল এবং প্রশিক্ষিত টিমের সমন্বয়।

কীভাবে কাজ করে এই ব্যবস্থা?

আকাশ প্রতিরক্ষার পুরো প্রক্রিয়া সাধারণভাবে তিনটি ধাপে কাজ করে:

১. শনাক্তকরণ ও ট্র্যাকিং:

প্রথমেই শত্রুর বস্তু (যেমন ড্রোন বা মিসাইল) আকাশে দেখা দিলে রাডার সেটি শনাক্ত করে। এই রাডার অনেক দূরের বস্তুও চিহ্নিত করতে পারে। এরপর সেন্সর ও সিস্টেম সেই বস্তুটির গতিপথ, গতি, উচ্চতা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে। কোনো বস্তু যদি সন্দেহজনক হয়, তখনই দ্বিতীয় ধাপে অ্যালার্ম বেজে ওঠে।

২. সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও লক্ষ্যবস্তু নির্বাচন:

এখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, এটি আক্রমণাত্মক কি না। যদি বোঝা যায় বস্তুটি শত্রুর এবং ক্ষতিকর, তখন টার্গেট করে সেটি ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

৩. প্রতিরোধমূলক আঘাত

সবশেষে আসে আসল প্রতিরোধ। এটি হতে পারে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে, লেজার ব্যবহার করে, বা এমনকি অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম দিয়ে। লক্ষ্য বস্তু ধ্বংস হয়ে গেলে সেটি মাটিতে পড়ার আগেই ক্ষতি রোধ করা যায়।

ইসরায়েলের আয়রন ডোম

ইসরায়েলের আয়রন ডোম সারা বিশ্বে অন্যতম সফল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শত্রুর রকেট শনাক্ত করে এবং আকাশেই তা ধ্বংস করে। ২০২১ সালে গাজা থেকে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস প্রচুর রকেট ছুঁড়েছিল ইসরায়েলের দিকে। তখন আয়রন ডোম প্রায় ৯০% রকেট মাঝ আকাশে ধ্বংস করে দেয়, যা ছিল এক বিশাল সাফল্য।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (CSIS)-এর গবেষক থমাস কারাকো বলেন, “আয়রন ডোম আমাদের দেখিয়েছে, একটি সঠিকভাবে ডিজাইন করা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে জীবন রক্ষা করতে পারে। এর গতি, নিখুঁততা এবং রেসপন্স টাইম অভাবনীয়।”

রাশিয়ার এস-৪০০

রাশিয়ার S-400 Triumph হচ্ছে আরেকটি অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা ৪০০ কিলোমিটার দূর থেকেও লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে পারে। এটি শুধু মিসাইল নয়, বিমানের বিরুদ্ধেও কাজ করে। ভারত, চীন, তুরস্কের মতো দেশগুলো রাশিয়ার কাছ থেকে এই সিস্টেম কিনেছে।

ন্যাটো-সংশ্লিষ্ট সামরিক বিশ্লেষক মাইকেল কাফম্যান বলেন, “এস-৪০০ হলো সেই ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যা প্রতিপক্ষকে আকাশে উঠতে দু’বার ভাবতে বাধ্য করে।”

বর্তমান যুদ্ধক্ষেত্রে এক নতুন ঝুঁকি হয়ে উঠেছে ড্রোন। এরা সস্তা, ছোট এবং নিচু দিয়ে উড়ে যায়, ফলে রাডারে ধরা পড়ে না। এজন্য এখন অনেক দেশ বিশেষ “অ্যান্টি-ড্রোন” ব্যবস্থা তৈরি করছে। যেমন আমেরিকা 'DroneDefender' নামে একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা ড্রোনের সঙ্গে থাকা রেডিও সিগনাল ব্লক করে তাকে থামিয়ে দেয়।

যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষক ড. লুসি ম্যাকডোনাল্ড বলেন, “ড্রোন এখন অনেকটা যুদ্ধের 'লুকানো অস্ত্র'। এদের ঠেকাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, লেজার ও ইলেকট্রনিক জ্যামিং একত্রে কাজ করছে।”

যদিও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো অনেক উন্নত, তবুও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যয়বহুল। যেমন একটি S-400 মিসাইল ছোঁড়ার খরচ প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। অপরদিকে একটি ড্রোনের দাম হয়ত ১০০০ ডলার। তাই সব আক্রমণের বিরুদ্ধে মিসাইল ছুঁড়ে প্রতিরক্ষা করাও বাস্তবসম্মত নয়।

এই প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ড. রিচার্ড হোয়াইট বলেন, “আকাশ প্রতিরক্ষা মানেই শুধু প্রযুক্তি নয়, এটা এক ধরনের গেম—কখন আঘাত করতে হবে, কখন ধৈর্য ধরতে হবে, সেটাই আসল কৌশল।”

ভবিষ্যতের যুদ্ধ আরও জটিল হতে চলেছে। অনেক দেশ এখন "হাইপারসনিক মিসাইল" বানাচ্ছে, যা এত দ্রুত চলে যে বর্তমান রাডারে ধরা পড়ার আগেই লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছে যায়। এদের বিরুদ্ধে কাজ করতে হলে নতুন ধরণের রাডার, আরও দ্রুতগামী প্রতিরক্ষা মিসাইল, এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ডারপা (DARPA) এখন এমন লেজার প্রযুক্তি তৈরি করছে, যা ড্রোন বা মিসাইলকে আলো দিয়েই পুড়িয়ে ফেলতে পারবে। গবেষক ড. এমিলি সং বলেন, “লেজার ভিত্তিক প্রতিরক্ষা পদ্ধতি আগামী দশকের যুদ্ধের নিয়ম বদলে দেবে।”

বাংলাদেশও সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। বাংলাদেশের বিমান বাহিনী ইতোমধ্যে চীন ও রাশিয়া থেকে বিভিন্ন ধরনের রাডার, অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্ট গান এবং মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রযুক্তিকে আরও আধুনিক করে তোলা দরকার, যাতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বজায় থাকে।

যুদ্ধ শুধু আগ্নেয়াস্ত্রের লড়াই নয়, এটি কৌশল ও প্রযুক্তির প্রতিযোগিতা। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একদিকে যেমন একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার হাতিয়ার, অন্যদিকে এটি একটি সতর্ক বার্তাও—যে শত্রু আকাশপথে এলে প্রস্তুত আছি আমরা। এই ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং মানব সিদ্ধান্ত একসঙ্গে কাজ করে। তাই যুদ্ধের আকাশে এই প্রতিরক্ষা ঢাল যেন নতুন যুগের এক অবিচ্ছেদ্য অস্ত্র।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

শেষ দিনে ৪৪২-সহ ডাকসুর মনোনয়ন সংগ্রহ ৫৬৫ প্রার্থীর

ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক জসীম উদ্দিন বলেন, সপ্তম দিনে ডাকসুর বিভিন্ন পদে জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছে ৪৪২ জন। এখন পর্যন্ত সাত দিনে ডাকসুতে মোট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ৫৬৫ জন এবং ১৮টি হল সংসদের জন্য মোট মনোনয়ন সংগ্রহ করেছে এক হাজার ২২৬ জন।

১৫ ঘণ্টা আগে

ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসের ইতিহাস

ইংল্যান্ডের সিংহাসন তখন ছিল এক জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। ইংরেজ রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর ১০৬৬ সালের জানুয়ারিতে উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল—কে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন? রাজ্যের প্রধান অভিজাতেরা হ্যারল্ড গডউইনসনকে রাজা ঘোষণা করলেন।

১৫ ঘণ্টা আগে

ডাকসুতে শিবিরের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম, জিএস পদে ফরহাদ

ডাকসুকে ভিপি পদে প্রার্থী সাদিক কায়েম শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি। অন্যদিকে জিএস পদে প্রার্থী এস এম ফরহাদ শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান সভাপতি।

১৭ ঘণ্টা আগে

ডাকসুতে শিবিরের প্যানেল ঘোষণা, নেতৃত্বে যারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিবিরের সাবেক সভাপতি সাদেক কায়েমকে ভিপি ও বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদকে জিএস করে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা করেছে সংগঠনটি।

২০ ঘণ্টা আগে