নীলক্ষেতেই ছাপা হয়েছে ডাকসুর ব্যালট, ঢাবিতে বিক্ষোভ

ঢাবি প্রতিনিধি
ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট নীলক্ষেতের অরক্ষিত পরিবেশে ছাপা হয়েছে বলে বিভিন্ন প্যানেল ও প্রার্থীদের তোলা অভিযোগ অস্বীকার করেছিল ডাকসুর নির্বাচন কমিশন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে অবশ্য উঠে এসেছে, সেগুলো নীলক্ষেতেই ছাপা হয়েছিল। ফাইল ছবি

ছাত্রদল-ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রার্থীদের অভিযোগের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন কমিশন তো বটেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষও বারবার দাবি করে আসছিল, নীলক্ষেত এলাকায় ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট পেপার ছাপার সুযোগ নেই।

কর্তৃপক্ষের দাবি, সর্বোচ্চ গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত উন্নত মানের ছাপাখানায় এ ব্যালট ছাপা হয়েছে বলেই দাবি তাদের। তবে বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিউজটুয়েন্টিফোরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নীলক্ষেতের গাউসুল আজম মার্কেটের একটি ছাপাখানাতেই অরক্ষিত পরিবেশে ছাপা হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট।

প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে অনলাইন-অফলাইনে। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেগুলো শক্তভাবে অস্বীকার করে আসায় এসব অভিযোগকে প্রার্থীদের নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেন অনেকেই। তবে ব্যালট পেপার ছাপা নিয়ে এই ডাকসু নির্বাচন কমিশনের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিরোধী বক্তব্য উঠে আসায় এ নির্বাচন নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠল।

এ নিয়ে এরই মধ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে। বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) শিক্ষার্থীরা হল থেকে বেরিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেছেন। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে তারা বিক্ষোভ করছেন।

নিউজটুয়েন্টিফোরের সরেজমিন পরিদর্শনে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বললে ছাপাখানার মালিকসহ অন্যরা জানান, নীলক্ষেতের অরক্ষিত পরিবেশেই ছাপানো হয়েছে ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট। সেখানে গোপনীয়তার কোনো বালাই ছিল না। সাধারণ ছাপাখানায় ছাপানোর পর সেখানকারই একটি দোকানে সেগুলো কাটিংয়ের কাজ করা হয়েছে।

এদিকে ছাপানো ব্যালটের সংখ্যা নিয়েও গড়মিলের তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে। নীলক্ষেতের ছাপাখানার মালিক বলছেন, ব্যালট পেপারের শিট ছাপানো হয়েছে ৪৮ হাজার, দুই পাশ মিলিয়ে ব্যালটের সংখ্যা ৯৬ হাজার। তবে ব্যালটগুলো যে দোকানে কাটিং করা হয়েছে, সেখানকার তথ্য বলছে ব্যালটের সংখ্যা ছিল ৮৮ হাজার।

অন্যদিকে ব্যালট ছাপানোর টেন্ডার পাওয়া আনজা করপোরেশনের চেয়ারম্যান জানান, এক লাখ ৫৩ হাজার ব্যালট ছাপিয়েছেন তিনি। এ-ও দাবি করেন, তার ব্যালটগুলো ছাপানো হয়েছে কেরানীগঞ্জে নিজের ছাপাখানায়। আবার ডাকসুতে ৩৯ হাজার ৭৭৫ ভোটারের প্রতিজনের জন্য ছয় পাতার ব্যালট পেপার হিসাব করলে মোট ব্যালট পেপারের প্রয়োজন হয় দুই লাখ ৩৮ হাজার ৬৫০টি।

ডাকসু নির্বাচন কমিশনের দাবি অনুযায়ী একটিমাত্র ভেন্ডরকেই টেন্ডারের মাধ্যমে ব্যালট পেপার ছাপার কাজ দেওয়া হয়েছিল। সেক্ষেত্রে আনজা করপোরেশন এক লাখ ৫৩ হাজার ব্যালট ছাপলে বাকি ব্যালট পেপারগুলো কোথায় ছাপা হয়েছে, তার কোনো হদিস মেলেনি।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নীলক্ষেতের গাউসুল আজম মার্কেটের জালাল প্রেসে ছাপা হয়েছে ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট পেপার। প্রেসের মালিক মো. জালাল সরাসরি স্বীকার করে নিয়েছেন, তার প্রেস থেকেই এ ব্যালট ছাপা হয়েছে। ফেরদৌস ওয়াহিদ নামে একজনের মাধ্যমে তিনি এ কাজ পেয়েছেন।

মো. জালালের ভাষ্য, তিন দিনের মধ্যেই তারা এই ব্যালট পেপার ছাপার কাজ শেষ করেছেন। ব্যালট সরবরাহের শেষ সময় ছিল ৭ সেপ্টেম্বর (৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে)। প্রেসের খোলামেলা পরিবেশে, এমনকি শাটার না আটকেই ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছে।

প্রেসমালিক জালাল আরও জানান, তার কাছ থেকে ৪৮ হাজার পিস ব্যালট নেওয়া হয়েছে। প্রতি কাগজে দুটি ব্যালট থাকায় এর সংখ্যা ছিল ৯৬ হাজার।

এদিকে জালাল প্রেস থেকে ছাপানো এসব ব্যালট পেপার ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কাটিংয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় মক্কা পেপার কাটিং হাউজে। দোকানটির মালিক ও কর্মচারীরাও জানান, ফেরদৌস নামে একজন তাদের কাজটি করতে বলেছেন। তবে তারা ৪৪ হাজার কাগজ কাটিং করেছেন। অর্থাৎ ৮৮ হাজার পিস ব্যালট পেপার ডেলিভারি দিয়েছেন তারা। রাত পৌনে ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে কাটিং করে রাখেন তারা। পরদিন (৮ সেপ্টেম্বর) সকালে সেগুলো নিয়ে যান ফেরদৌস ওয়াহিদের লোকজন।

ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট পেপার ছাপা ও ওএমআর মেশিনে গণনা করার কাজের টেন্ডার পেয়েছিল আনজা করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জাহিদ হোসেনের দাবি, কেরানীগঞ্জে তার নিজের প্রেসে ব্যালট ছাপানো হয়েছে এক লাখ ৫৩ হাজার ব্যালট।

নীলক্ষেতের প্রেস ও কাটিং হাউজের সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য জানালে জাহিদ বলেন, তিনি দেশের বাইরে থাকায় তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কাজটি করেছেন। তারা নীলক্ষেত থেকে সেটি ছাপিয়ে থাকতে পারেন।

অনুসন্ধানে উঠে আসা তথ্যপ্রমাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, এটি হাইলি স্পেশালাইজ একটি প্রসেস। এর একেকটি মেশিনের দাম মিনিমাম ৫০ লাখ, ৬০ লাখ, ৭০ লাখ টাকা। আমরা যখন এটা যখন টেন্ডার করেছি, তখন একমাত্র একটি ব্র্যান্ড আবেদন করে। অন্য কারও কাছে এই মেশিন ছিল না।

নীলক্ষেতে ব্যালট ছাপানোর তথ্য-প্রমাণ আছে জানালে অধ্যাপক জসীম বলেন, প্রমাণ থাকলে আমাদের প্রশাসন খতিয়ে দেখবে।

অভিযোগ আগে থেকেই

এর আগে নীলক্ষেতের গাউসুল আজম মার্কেটের একটি ছাপাখানায় ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের বিপুলসংখ্যক ব্যালট পেপার অরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ তোলে ছাত্রদল। সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) এটিসহ মোট ১১টি অভিযোগ তারা সংবাদ সম্মেলন করে তুলে ধরে।

মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদেরসহ আরও কয়েকজন প্রার্থী ঢাবি প্রশাসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানেও তারা গাউসুল আজম মার্কেটে ব্যালট পেপারের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

সবশেষ আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সংবাদ সম্মেলন করে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ১২ দফা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেছে। সেখানেও নীলক্ষেতের ছাপাখানায় বিপুলসংখ্যক অরক্ষিত ব্যালট পেপার উদ্ধার, ব্যালট পেপার ছাপানোর জায়গা প্রকাশ না করাসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে।

ঢাবি প্রশাসনের অস্বীকার

বিভিন্ন প্যানেল ও প্রার্থীদের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ তোলা হলেও ব্যালট ইস্যুতে অনিয়মের অভিযোগ বারবারই অস্বীকার করে এসেছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ ও ডাকসু নির্বাচন কমিশন। গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগ করা হলে ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক জসীম বলেন, ব্যালট অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় এটি ছাপার প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ গোপনীয়তা ও মান বজায় রাখা হয়েছে।

পরে বিভিন্ন মহল থেকে ওঠা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের উপপরিচালক ফররুখ মাহমুদের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, ডাকসুর ব্যালট ‘পরীক্ষিত’ প্রতিষ্ঠান বিশেষ প্রক্রিয়ার ছাপিয়েছে, যা নীলক্ষেতের কোনো দোকানে ছাপানো সম্ভব নয়।

ঢাবিতে বিক্ষোভ

এদিকে নীলক্ষেতে ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট পেপার ছাপা হওয়া নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেছেন। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার রাতে ঢাবি উপচার্যের বাসভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের ‘ভিসি স্যার জানেন নাকি, নীলক্ষেতের নায়ক আপনি’, ‘নীলক্ষেত না ডাকসু, নীলক্ষেত নীলক্ষেত’, ‘ভিসি না নীলক্ষেত, নীলক্ষেত-নীলক্ষেত’সহ নানা স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা।

বিক্ষোভকারীদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এম এ মহমিতুর রহমান পিয়াল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছিল, নীলক্ষেতে জ্যান্ত মানুষ বানানো সম্ভব হলেও ব্যালট পেপার নীলক্ষেত থেকে ছাপানো হয়নি। সেটি অত্যন্ত গোপনীয় বলে কর্তৃপক্ষ ব্যালট ছাপানোর স্থান প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কিন্তু আজ আমরা খবরে দেখলাম, সেগুলো নীলক্ষেত থেকেই ছাপানো হয়েছিল। এমনকি যে ব্যবসায়ী ছাপার কাজ করেছেন তিনি নিজেই বলেছেন, তিনি কখনো অনৈতিক কাজে না জড়ালেও ঢাবি প্রশাসন তাকে ‘অনৈতিক কাজ’ করতে বাধ্য করেছে।

বিক্ষোভকারীরা বলেন, অনেকেই অভিযোগ দিয়েছে, যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রতিটি অভিযোগ একেক রকম। কিন্তু সব অভিযোগই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অগ্রাহ্য করেছে। আমরা দেখেছি, প্রতিটি অভিযোগেরই কিছু না কিছু ভিত্তি আছে। আমরা আশা করব, অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে সব অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হবে। সেই তদন্তের ভিত্তিতে আমরা আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম এগিয়ে নেব।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

হামলাকারীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা করলেন আখতার

মামলায় দুজনের নাম উল্লেখ করে ১৫ থেকে ২০ জন অজ্ঞাতনামা নাম দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে। আখতারের অভিযোগ, ওই দিনের হামলার পরও এয়ারপোর্টের লবিতে এবং অন্যান্য জায়গায় তারা নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করছে।

১৪ ঘণ্টা আগে

আ.লীগ পুনর্বাসনে জামায়াতের ইন্ধন রয়েছে : রিজভী

তিনি বলেন, ‘জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি উদ্বেগজনক। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের আগ্রহ এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাওয়া জামায়াতের ভিন্ন উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত বহন করছে।’

১৪ ঘণ্টা আগে

দেশকে অস্থিতিশীল করতে পিআর চাওয়া হচ্ছে: সালাহউদ্দিন

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, দেশে অনৈক্য ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্টে এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।

১৪ ঘণ্টা আগে

দ্রুতই বিএনপি মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে: ডা. জাহিদ

এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডা. জাহিদ বলেন, ১৮ মাস আগ থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এখন পর্যন্ত কাউকে মনোনয়নের বিষয়ে সবুজ বা লাল সংকেত দেওয়া হয়নি। তবে খুব দ্রুতই মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে।

১৫ ঘণ্টা আগে