একাত্তরে বিতর্কিত ভূমিকা

গোলাম আযম, নিজামীসহ জামায়াত নেতারা ক্ষমা চেয়েছেন?

বিবিসি বাংলা
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর গোলাম আযম (বামে) ও মতিউর রহমান নিজামী (ডানে)

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে ৫৫ বছর পরও ক্ষমা না চাওয়ায় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীকে। এনিয়ে দলটির নেতারা বিভিন্ন সময়ে নানা বক্তব্য দিয়েছেন।

সবশেষ জামায়াতের বর্তমান আমীর শফিকুর রহমান ১৯৪৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তাদের দ্বারা কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে, বিনাশর্তে মাফ চেয়েছেন। কিন্তু ১৯৭১ সাল বা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রসঙ্গ সুনির্দিষ্টভাবে তার বক্তব্যে আসেনি।

একইসাথে তিনি দাবি করেছেন, এর আগেও দলটির আরও দুই নেতা ক্ষমা চেয়েছেন। তবে এনিয়েও রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে নানা আলোচনা।

প্রশ্ন উঠছে, ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করার যে অভিযোগ দলটির বিরুদ্ধে আছে, সে বিষয়ে আদৌ কি গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামীসহ দলটির নেতারা কখনও ক্ষমা চেয়েছেন?

না কি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজনীতিতে সক্রিয় দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর যে প্রভাবশালী অবস্থান দৃশ্যমান হচ্ছে, সে জায়গা থেকে ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার চিন্তা থেকে মানুষের সহানুভূতি পেতে দলটির আমীর নতুন করে ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গের অবতারণা করছেন, এমন প্রশ্নও তুলছেন অনেকে।

ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন নেতাদের বক্তব্যগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিশ্লেষকদের।

দলটির নেতাদের এসব বক্তব্যে একাত্তর নিয়ে বিতর্কের মীমাংসা হচ্ছে না বলেও মনে করছেন তারা।

আদৌ কি ক্ষমা চেয়েছেন জামায়াত নেতারা?

জামায়াতে ইসলামের প্রসঙ্গ এলেই আলোচনায় আসে ১৯৭১ সালে দলটির ভূমিকার কথা।

সেসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার জন্য জামায়াতের সহায়তায় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হয়।

এসব মিলিশিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে রয়েছে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের নানা দালিলিক প্রমাণ।

স্বাধীনতার ৪২ বছর পর একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড হয় দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতার, যদিও সেই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ছিল জামায়াতের।

কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য এখন পর্যন্ত দলীয় বা আনুষ্ঠানিকভাবে দোষ স্বীকার করেনি তারা।

পাঁচ মাস আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম এজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাসের রায় হয়।

এনিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের আমীর শফিকুর রহমান বলেন, "মানুষ আমরা কেউ ভুলের উর্ধ্বে না। দল হিসেবে দাবি করি না, আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে। এ সংগঠনের প্রতিটি কর্মী, সহকর্মী কিংবা দলের দ্বারা যে যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন, সবার কাছে বিনা শর্তে মাফ চাই। আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দেবেন"।

গত ২২শে অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে প্রসঙ্গটি আবারও আলোচনায় এলে শফিকুর রহমান বলেন, "শুধু ৭১ না, সাতচিল্লশ থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের আজকে ২২শে অক্টোবরের এখানকার টাইম রাত ৮টা ১১ মিনিট – এই পর্যন্ত আমাদের দ্বারা যে যেখানে যত কষ্ট পেয়েছেন, আমরা বিনা শর্তে যারা কষ্ট পেয়েছেন তাদের কাছে মাফ চাই। এটা গোটা জাতি হলেও চাই, ব্যক্তি হলেও চাই। কোনো অসুবিধা নাই"।

তিনি দাবি করেন, তার আগে এই 'এপোলজি' তারা অন্তত আরও তিনবার দিয়েছেন। এসময় একজন সাংবাদিক তাকে বলেন "কেউ কেউ শুধু একাত্তর নিয়ে ক্ষমা চাইতে বলে"।

তার জবাবে শফিকুর রহমান বলেন, "শুধু একাত্তরেই ভুল করেছি আর করি নাই? আর যারা আমাদের ক্ষমা চাইতে বলে তারা ফেরেশতার দল?"

অনেকটা একই ভাষায় ১৯৯৪ সালে "দুঃখ প্রকাশ" করেছিলেন দলটির তৎকালীন আমীর গোলাম আযম।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য বাতিল করা নাগরিকত্ব ফেরত পাবার পর ঢাকার বায়তুল মোকাররমের সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, "ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের এবং জনগণের ক্ষতির কোনো চেষ্টা আল্লাহর রহমতে আমি কোনোদিন করিনি। যা ভালো বুঝেছি দেশের জন্য, জনগণের কল্যাণের জন্য – করেছি। এরপরও মানুষের ভুল হয়। ভুল হতে পারে। কেউ আমার কোনো কাজকে ভুল মনে করতে পারেন"।

"নবী ছাড়া কে দোষী নয়? দোষ কমবেশি সবারই আছে। তাই যারা আমার কোনো কাজকে ভুলে মনে করেছেন, আমার কোনো কাজে অসন্তুষ্ট হয়েছেন, আমার কোনো কাজে ব্যথিত হয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন – আমি তাদের সবাইকে জানাচ্ছি, আমিও আপনাদের বেদনার সাথে শরিক, আমিও দুঃখিত", বলেন তিনি।

একাত্তর নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে কয়েকদিন আগে জামায়াতের আমীর বলেছিলেন, তার আগে ক্ষমা চাওয়া আরও দুই জামায়াত নেতাদের একজন দলটির সাবেক আমীর মতিউর রহমান নিজামী।

যদিও নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, মি. নিজামী তার বক্তব্যে একাধিকবার একাত্তরে দলটির ভূমিকাকে "রাজনৈতিক" দাবি করলেও কখনও কোনো ভুল স্বীকার করেননি।

২০০৫ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "১৯৭১ সালে তারা যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেটা ছিল রাজনৈতিক ভূমিকা, তারা ১৬ই ডিসেম্বরের পরে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছেন"।

১৯৭১ সালে দলটির ভূমিকা ভুল থাকার বিষয়টি জামায়াতে ইসলামী স্বীকার করে নিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নিজামী বলেছিলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নানা মতের সুযোগ আছে। কেউ এটাকে ভুল বলতে পারে, কেউ কেউ অন্যভাবেও বলতে পারে।

তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক ভূমিকার বাইরে কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী জড়িত ছিল না বলেও সেসময় দাবি করেন তিনি।

জামায়াতের আমীরের বক্তব্য কি দলীয় বক্তব্য?

সরকারিভাবে স্বীকৃত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান। ধর্ষণের স্বীকার হন দুই লক্ষ নারী। সেই অপরাধে সরাসরি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ থাকার পরও দল হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি জামায়াত।

এবারও পাঁচ মাসের ব্যবধানে দলটির প্রধান নেতা দুইবার ক্ষমা চাইলেও সময় বা অপরাধের বিষয়টি স্পষ্ট করেননি, যেমনটা দেখা গেছে গোলাম আযমের বেলাতেও।

তবে মি. আযম ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ প্রকাশ করলেও বর্তমান জামায়াতে আমীরের ক্ষমা চাওয়ার দুইটি ঘটনাতেই তিনি "আমরা" শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন তাহলে কি তিনি দলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছেন?

যদিও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে জামায়াতের আমীরের বলা কথা দলের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়, এমনটি বলছেন দলটির কেউ কেউ।

"ভুলতো হইতেই পারে উনি বলেছেন মানুষ হিসেবে। এই সকল কিছুর জন্য উনি নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। সুতরাং এটা আমাদের দলীয় বক্তব্য না হলেও যেহেতু এটা আমীরে জামায়াত বলেছেন, আমরা ওনার বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করি না", বিবিসি বাংলাকে বলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের।

একইসাথে ৭১ নিয়ে আলোচনা বা যুক্তিতর্কে সে ঘটনাকে অতীত হিসেবেই দেখাতে চায় জামায়াত, যার সঙ্গে মেলে বর্তমান ও সাবেক জামায়াতে আমীরের কথা।

১৯৯২ সালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, "আমাদের সেসময় রাজনৈতিক অবস্থানটা ভিন্ন ছিল, সেটা সকলের জানা। আমরা বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের হেফাজতের জন্য আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি"।

সম্প্রতি নিউইয়র্কে দেওয়া বক্তব্যে শফিকুর রহমান বলেন, "যে জাতি চিংড়ি মাছের মতো লাফাইতে গিয়া শুধু পিছনের দিকে যায়, সেই জাতির কোনো ভবিষ্যৎ নাই"।

'এগুলোতো ক্ষমা চাওয়া না'

আজ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য দলীয় বা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি জামায়াত।

২০২৪ সালের পাঁচই অগাস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রভাবশালী দল হিসেবে দেখা যাচ্ছে দলটিকে। জনসাধারণের সমর্থন পেলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নও দেখছেন জামায়াতের নেতারা।

আর সেই লক্ষ্যেই দলটির অবস্থান নিয়ে নানা সময়ে ওঠা প্রশ্ন-সমালোচনা বন্ধে তারা কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছেন, আছে এমন আলোচনা।

ফলে সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের নেতাদের অবস্থান নিয়েও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে সন্দেহ রয়েছে।

এনিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী আনু মুহাম্মদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এগুলোতো ক্ষমা চাওয়া না। এগুলো হচ্ছে সমাজের সমালোচনার মুখে একটা পালিশ দেওয়া আর কি। একটা কোনো রকম দায়সারা গোছের কথা বলে তাদের সমর্থকদের বা তাদের নিয়ে যারা প্রশ্ন করছে, তাদের সমালোচনা বন্ধ করার একটা চেষ্টা"।

কিন্তু এভাবে দায় এবং দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, "দায় নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবেতো বটেই, যে রাজনীতি এবং মতাদর্শের কারণে এমন ঘটনা ঘটে, সেটা থেকে না বের হলেতো ওটারই ধারবাহিকতা আমরা দেখতে থাকবো। যেটার লক্ষণ এখনই আমরা দেখতে পাচ্ছি"।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

‘৫ উপদেষ্টাকে এনসিপির আজ্ঞাবহ বানাতে না পেরে ট্যাগিং করা হচ্ছে’

তিনি বলেন, ‘তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সদস্যের লিয়াজোঁ কমিটির পরামর্শে এই পাঁচজন উপদেষ্টাসহ বাকি উপদেষ্টাদের সিলেকশন করা হয়। হয়তো এই পাঁচ উপদেষ্টাকে এনসিপির আজ্ঞাবহ বানাতে না পেরে ট্যাগিং করা হচ্ছে।’

২১ ঘণ্টা আগে

ক্ষমতায় গেলে মায়েদের কর্মঘণ্টা হবে ৫: জামায়াত আমির

শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে ইনশাআল্লাহ তাদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেবো, মা হিসেবে সন্তানের হক আদায় করার জন্য এবং মা হিসেবে তাকে সম্মান করার জন্য। আমরা যদি আট ঘণ্টার জায়গায় পাঁচ ঘণ্টা করি, তাহলে মায়েরা এতই কমিটেড যে তারা চিন্তা করবে সরকার যে সম্মান আমাদের দিয়েছে, আমাদের উচিত আট ঘণ্টার কাজ পা

১ দিন আগে

সরকারে গেলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করবে বিএনপি: আমীর খসরু

এই বিভাগ তৈরি করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে। এর উদ্দেশ্য ছিল এমডি নিয়োগ ও পর্ষদে পছন্দের লোক বসিয়ে লুটপাট করা। বিএনপি আগের বার ক্ষমতায় এসে এটি তুলে দিয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা এটি আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আবার এটি বিলুপ্ত করবে।

১ দিন আগে

সবাইকে নিয়ে ‘নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে’ চায় বিএনপি

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সারা দেশে আসনভিত্তিক সব যোগ্য প্রার্থীদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। আমরা একটাই বার্তা দিতে চাই, যেন দলের ভেতরে ঐক্য থাকে, জাতির মধ্যে ঐক্য থাকে। যাদের সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দেোলন করেছি তাদেরসহ সবাইকে নিয়ে একটি বৃহৎ জোটের জন্য আমরা চিন্তা করছি, সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে যেন আমরা এই নি

১ দিন আগে