তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটল?

বিশেষ প্রতিনিধি, রাজনীতি ডটকম
তারেক রহমান। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম— রাজনীতি প্রসঙ্গে সবচেয়ে প্রশ্ন একটিই— তারেক রহমান দেশে ফিরবেন কবে!

ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশবাসী ভেবেছিল, এ প্রশ্নের উত্তর মিলতে বুঝি আর বাকি নেই। বিশেষ করে ২০২৪ সালের শেষার্ধেই যখন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ সব রাজনৈতিক ও হয়রানিমূলক মামলায় তারেক রহমান খালাস পান, বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ধরেই নিয়েছিলেন যে তাদের অপেক্ষার অবসান হয়তো হয়েই গেল।

কিন্তু না। বর্ষপঞ্জির পাতা থেকে আরও একটি বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু দেশে ফেরেননি তারেক রহমান। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের আশ্বাস দেওয়ার পর নির্বাচন কমিশনও ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে। কিন্তু তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিশ্চিত হয়নি। সবশেষ নভেম্বরের শেষ ভাগে এসে মা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় তার দেশে ফেরা বাস্তবে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

সোমবার (১ ডিসেম্বর) রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটি বৈঠক করে। ওই বৈঠকের পর স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, খুব শিগগিরই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরবেন।

মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) বিকেলেও প্রায় একই কথা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে শিগগিরই তারেক রহমান দেশে ফিরবেন।

সালাহউদ্দিন আহমদ ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য এবং খালেদা জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার হয়তো তারেক রহমানের দেশে ফেরার গুঞ্জন আগের মতো ফাঁকা বুলি নয়, এবার হয়তো সত্যিই তিনি দেশে ফিরছেন।

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে দীর্ঘ দিনের যে ধোঁয়াশা, তার প্রেক্ষাপট অনেক বিস্তৃত। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ যখন সব মামলা থেকেই তারেক রহমান খালাস পান তখন তিনি কেন দেশে ফেরেননি, এ প্রশ্ন রয়েছে অনেকেরই। এর পেছনে বিশ্লেষকরা খুঁজে পান ওয়ান-ইলেভেনের সময়কার সংশ্লিষ্টতা।

সেনা-সমর্থিত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছিল। ওই সময় তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, রিমান্ডের নামে তার ওপর চালানো হয়েছিল অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। সেই শারীরিক যন্ত্রণা ও মানসিক ট্রমা আজও তাকে তাড়া করে ফেরে বলে মনে করেন অনেকেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদের মতে, সে সময় যারা তাকে নির্যাতন করেছিল, সেই ‘শক্তি’ বা তাদের উত্তরসূরিরা হয়তো এখনো প্রশাসনের গভীরে বা ‘ডিপ স্টেটে’ সক্রিয়। চব্বিশের পটপরিবর্তনের পরও হয়তো নিরাপত্তা বাহিনীর সেই বিশেষ অংশের সঙ্গে তারেক রহমানের ‘বোঝাপড়া’ বা ‘ক্লিয়ারেন্স’ সুরাহা হয়নি।

লন্ডনে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর ছেলে তারেক রহমানের বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন খালেদা জিয়া। সেখানেই ক্যামেরাবন্দি মা-ছেলে। ছবি: তারেক রহমানের ফেসবুক থেকে
লন্ডনে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর ছেলে তারেক রহমানের বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন খালেদা জিয়া। সেখানেই ক্যামেরাবন্দি মা-ছেলে। ছবি: তারেক রহমানের ফেসবুক থেকে

ড. সাব্বির বলেন, বিএনপি হয়তো ভেবেছিল, তারেক রহমান যদি হুট করে দেশে ফেরেন, তবে সেই পুরোনো কুশীলবরা আবারও নতুন কোনো ফাঁদ পাততে পারে। তাই আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা থেকে খালাস পেলেও যতক্ষণ না সেই ‘অদৃশ্য ক্লিয়ারেন্স’ বা শতভাগ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা মিলছিল, ততক্ষণ তিনি ঝুঁকি নিতে চাননি। গত এক বছর ধরে তার না ফেরাটা ছিল মূলত এই ‘অদৃশ্য দেয়াল’ ভাঙার অপেক্ষা।

সেই ‘অদৃশ্য দেয়াল’ হয়তো এবার ভেঙে পড়েছে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এবং তার জন্য বরাদ্দ নতুন নিরাপত্তা প্রটোকল। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসাধীন। দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি ও চোখের জটিলতায় ভুগতে থাকা ৮০ বছর বয়সী এই নেত্রী সবশেষ আক্রান্ত হয়েছেন নিউমোনিয়ায়।

দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ‘অত্যন্ত সংকটময়’। এরপের তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে চিকিৎসকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে সবুজ সংকেত মেলেনি।

এর মধ্যে খবর ছড়িয়েছে, খালেদা জিয়াকে ভেন্টিলেশনে বা লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। তবে সবশেষ মঙ্গলবার দুপুরে সাংবাদিকদের সামনে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার তথ্য তুলে ধরেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। বলেন, খালেদা জিয়াকে যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে তা তিনি গ্রহণ করতে পারছেন। কোনো ধরনের গুজবে কান না দিতে দলের পক্ষ থেকে আহ্বান জানান তিনি।

মায়ের এই অন্তিম মুহূর্তে সন্তান পাশে থাকবেন— এটাকেই স্বাভাবিক মনে করা হয়। কিন্তু তারেক রহমান মায়ের সংকটাপন্ন অবস্থাতেও ‘স্পর্শকাতর’ কারণে দেশে ফিরতে পারছিলেন না বলে জানিয়েছিলেন। সবশেষ সরকারের একটি সিদ্ধান্ত হয়তো তাকে তার সেই অনিশ্চয়তা কাটাতে ভূমিকা রাখতে পারে।

সরকার সোমবার খালেদা জিয়াকে ‘ভিভিআইপি’ ঘোষণা করেছেন। এর ফলে এখন খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্ব এখন সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত করা হয়েছে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) হাতে। এভারকেয়ার হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে দুই পাশে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে, মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। অপ্রয়োজনে হাসপাতালে প্রবেশ ঠেকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারেক রহমান যদি কোনো ‘ডিপ স্টেট’ বা ‘অদৃশ্য শক্তি’র ভয় পেয়েও থাকেন, মায়ের এসএসএফ প্রটোকল ও হাসপাতালের কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা সেই ভয়কে অনেকটাই নস্যাৎ করে দিয়েছে। কারণ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বাহিনী যখন পাহারায়, তখন অন্য কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের পক্ষে কারও ক্ষতি করাটা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে, তারেক রহমানের ফেরায় সরকারের তরফ থেকে কোনো বাধা নেই। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এ কথা জানিয়েছেন। একাধিকবার এ কথা বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও। সবশেষ মঙ্গলবার তিনি বলেন, তারেক রহমানএখনো ট্রাভেল পাসের আবেদন করেননি। আবেদন করলে সরকার তা ইস্যু করে দেবে। দেশে ফেরার বিষয়ে তারেক রহমানকে সরকার সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।

এর মধ্যে অবশ্য একটি বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল তারেক রহমানের উপদেষ্টা ড. মাহাদী আমিনের একটি বক্তব্য ঘিরে। তিনি বলেছিলেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

তার এ বক্তব্যের পর অনেকেই ভেবেছিলেন, তারেক রহমানের তাহলে হয়তো আর ফেরা হবে না। তবে সূত্র বছে, এটি ছিল মূলত ‘প্ল্যান বি’ বা পরিস্থিতির একটি বিকল্প পরিকল্পনা। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রা স্থগিত হওয়ার অর্থ— তারেক রহমানেরই দেশে ফেরার কোনো বিকল্প নেই। মা যদি ছেলের কাছে যেতে না পারেন, তবে ছেলেকে আসতেই হবে— এমন আভাস মিলেছে বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যেও।

২০২৪ সালের মধ্যে সব মামলায় খালাস পাওয়ার পরও তারেক রহমানের দেশে না ফেরাকে অবশ্য ‘রাজনৈতিক কৌশল’ হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুন আল মোস্তফা। তিনি বলেন, এ কৌশলগত নীরবতা দলের কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের রহস্য ও আকর্ষণ জিইয়ে রাখে। নেতা কখন আসবেন— এ অপেক্ষাই কর্মীদের চাঙ্গা রাখে। তাছাড়া বিএনপি হয়তো চেয়েছিল নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে তাদের ‘তুরুপের তাস’ (তারেক রহমানের দেশে ফেরা) চালতে।

কিন্তু মায়ের অসুস্থতা সেই রাজনৈতিক টাইমিং বা কৌশলকে ছাপিয়ে গেছে। এখন আর কোনো কৌশলের অবকাশ নেই। দল ও পরিবারের অস্তিত্বের স্বার্থেই তারেক রহমানকে এখন ফিরতে হচ্ছে। তার ফেরার পথে ওয়ান-ইলেভেনের যে ‘অদৃশ্য শক্তি’র বাধার কথা বলছিলেন অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ, তা এখন কেটে যাওয়ার পথে বলেও মনে করেন তিনি।

অধ্যাপক সাব্বির বলেন, গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে বড় ধরনের রদবদল করেছে। ওয়ান-ইলেভেনের সেই পুরোনো কুশীলবদের ছায়া এখন আর প্রকাশ্য নয়। নতুন প্রশাসনের অধীনে তারেক রহমান নিজেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ মনে করছেন। এ ছাড়া পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ভালো। আঞ্চলিক রাজনীতিতেও ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ। সব মিলিয়ে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে গ্রিন সিগন্যালই দৃশ্যমান।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের ফেসবুক আইডি হ্যাকড

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডি হ্যাকড হয়েছে বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ভেরিফায়েড ফেসবুকে আইডি থেকে তিনি বলেন, 'আমার ফেসবুক আইডি হ্যাকড।'

৪ ঘণ্টা আগে

খালেদা জিয়া দেশের গণতন্ত্রের জন্য আপসহীন নেত্রী : রাশেদ খান

রাশেদ খান বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হতে হবে। ভারতীয় আধিপত্যবাদীরা নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষশক্তির রাজনৈতিক দলগুলো এসব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে প্রস্তুত।’

৪ ঘণ্টা আগে

'দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে ধনী-গরিব সবাই উপকৃত হবে'

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ধনী-গরিব সবাই উপকৃত হবে। অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জামায়াতের কঠোর অবস্থান ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে বলেও জানান তিনি।

৫ ঘণ্টা আগে

খালেদা জিয়ার অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে দ্রুত দেশে ফিরবেন তারেক রহমান

মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর তারেক রহমান দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেবেন। পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে তিনি শিগগিরই দেশে ফিরবেন।

৫ ঘণ্টা আগে