ভোটের আগে জোটের হিড়িক

শাহরিয়ার শরীফ
নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি। গ্রাফিক্স: রাজনীতি ডটকম

জুলাই গণঅভুত্থান-পরবর্তী প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে দেশ। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই এই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল। এর আগেই নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নতুন নতুন জোট গঠন, আসন সমঝোতা আর দরকষাকষির লড়াই। দলের সঙ্গে দলের চলছে মান-অভিমানও।

ভোটের অঙ্ক মেলাতে বড় থেকে ছোট— সব দলই এখন জোট রাজনীতির ছায়ায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করার প্রাণপন চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে জোট গঠনের খেলায় পিছিয়ে নেই বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, বাম ঘরানার দল এবং এমনকি গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে গড়ে ওঠা এনসিপিও।

গত কয়েক দিনের মধ্যেই নির্বাচন ঘিরে অন্তত পাঁচটি বড় জোট মাঠে সক্রিয় হয়েছে। যেসব দল এখনো জোটে যুক্ত হয়নি, তারাও যেকোনোভাবে জোটে যুক্ত হয়ে নির্বাচনের লড়াইয়ে নামার পথেই রয়েছে।

এভাবে একের পর এক জোটের যাত্রা শুরু হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন পর্যন্ত আসন বণ্টন চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে বাড়ছে জটিলতা। ক্ষোভে-অভিমানে কেউ কেউ জোট থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ আবার সরে দাঁড়ানো হুমকি দিচ্ছেন।

দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী আর জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতার সংখ্যা অনেক বেশি। আবার এই দীর্ঘ সময়ে রাজপথের আন্দোলনে সঙ্গী দলগুলোর প্রত্যাশাও বেশি বিএনপির কাছে। এ অবস্থায় অভিমান করা মিত্রদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে সমস্যা সমাধানে দল থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। দলের মধ্যেও প্রার্থিতা নিয়ে রয়েছে বিরোধ।

সবশেষ মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) রাতে বিএনপির গুলশানের কার্যালয়ে ছয়-দলীয় মোর্চা গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের নেতৃত্বে বৈঠক হয়। জানা যায়, বৈঠকের আলোচনা মনঃপূত না হওয়ায় বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা সাইফুল হক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বের হয়ে আসেন।

এদিকে নির্বাচনে জামায়াতসহ আট দলের মধ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি নেতারা। সমঝোতা করে প্রার্থী বাছাইয়ের কথা বললেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন একমঞ্চে আসা আট দল। তুলনামূলক ছোট দলগুলোর আসন চাহিদা মেটাতে গিয়ে ঘাম ঝড়ছে জামায়াত নেতাদের।

জানা গেছে, এই জোটের সবচেয়ে বেশি আসনে নির্বাচন করবে জামায়াত। এরপর চরমোনাই পিরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বাকি দলগুলোও চাহিদামাফিক আসন সমঝোতা করতে চাইছে। এ নিয়ে দুই দফা বৈঠক হলেও এখনো সমাধান হয়নি বলে জানা গেছে।

কোন জোটের কী হাল?

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় বলয় হচ্ছে বিএনপি ও সমমনা জোট। আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিবাদী শাসন’বিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে থাকা এই জোটকে কেন্দ্র করেই চলছে মূল সমীকরণ। সমমনা দলগুলোর কাছ থেকে আগে আসন চাহিদা নিলেও বিএনপি দুই দফায় ২৭২টি আসনে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

বাকি ২৮টির মধ্যে চারটি আসনে সীমানা জটিলতার কারণে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। ১২ থেকে ১৫টি আসন শরিক দলগুলোর জন্য বরাদ্দ দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। বাকি আসনগুলোতে শরিকদের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনাই এখন বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাজনৈতিক মিত্র দলগুলো। ফলে চাপে থাকা বিএনপি আলোচনা করে সমমনা দলের সঙ্গে আসন সমন্বয় করতে আলোচনায় বসতে শুরু করেছে।

প্রথম দিনের বৈঠকে ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক প্রয়োজনে ঢাকা-১২ আসনে হলেও নির্বাচন করতে চান বলে জানান। কারণ তিনি এ এলাকার বাসিন্দা ও ভোটার। কিন্তু ঢাকা-৮ আসনে মির্জা আব্বাস আর ঢাকা-১২ আসনে সাইফুল আলম নীরবকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। দুটি আসনেই প্রার্থী পরিবর্তন করা অনেকটা অসম্ভব— বিএনপির পক্ষ থেকে এমন মনোভাব দেখানো হলে আলোচনা অসমাপ্ত রেখে চলে যান সাইফুল হক।

বিএনপির মিত্র দল ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘বিএনপি তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাদের সবাইকে আসন ছাড় দেবে— এটা প্রত্যাশা করি। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই, বিএনপি তাদের প্রতিশ্রুতি রাখবে। অন্যথায় যেকোনো পরিস্থিতির দায় তাদের ওপর বর্তাবে।’

এদিকে নুরুল হক নুর ও রাশেদ খানের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। দলটির একাংশ বিএনপির সঙ্গে জোট বা সমঝোতায় যেতে আগ্রহী। দলের আরেক অংশের যোগাযোগ জামায়াত ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ৮ দলের জোটের সঙ্গে।

গণঅধিকারের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘আমাদের বিএনপি ও জামায়াত উভয় পক্ষের সঙ্গেই আলোচনা চলছে। পাশাপাশি নতুন জোটগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। দেশের জন্য, দলের জন্য যা ভালো হবে সেইভাবেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’

এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে চাহিদামাফিক আসনের নিশ্চয়তা না পেয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরও। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনাও আমাদের অনেকগুলো আসন, আসন প্রতি ৫০ লাখ টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু আমরা যাইনি। এখন একটা-দুইটা আসন নেওয়ার জন্য আমরা বসে নেই।’

জামায়াতে ইসলামীর জোটে একই ধরনের অবস্থানে রয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। বিএনপি ও আট দলের উভয় জোটের সঙ্গেই তাদের আলোচনায় রয়েছে বলে জানা গেছে।

ভোটের মাঠে আপাতত বিকল্প শক্তি হয়ে ওঠা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন আট দলের জোট ‘ওয়ান বক্স পলিসি’, অর্থাৎ সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতি আসনে জোটের দলগুলো থেকে যেকোনো একজন প্রার্থীর নীতি গ্রহণ করেছে। এ নীতি মেনেই প্রার্থী বাছাই শুরু করেছে দলগুলো।

জানা গেছে, জামায়াতের কাছে আসন ছাড় চাচ্ছে শরিকরা। জামায়াত সর্বোচ্চ ছাড় দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত শরিকদের চাহিদা পূরণ করতে পারবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

জামায়াতে ইসলামী ও আট দলীয় জোটের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আসন সমঝোতা নিয়ে লিয়াজোঁ কমিটির আরও বৈঠক হবে। সেখান থেকে সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে দলগুলোর নেতারা আশাবাদী।

শরিক দলের একজন শীর্ষ নেতা রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘ভোটের মাঠে কার কতটা সক্ষমতা আছে তা বিবেচনা করে আসন সমঝোতা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সবাই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখালে দ্রুত সমাধানে পৌঁছানো যাবে।’

এদিকে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) জোট রাজনীতিতে ঢুকেছে। এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনকে নিয়ে তারা ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’ গঠন করেছে। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, সামনে আরও দল এতে যুক্ত হতে পারে।

এবি পার্টির পর বুধবার এনসিপির পক্ষ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রথম ধাপে ১২৫ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি আসনে পরে ঘোষণার কথা বলা হয়েছে।

এদিকে রাজনীতিতে পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়া জাতীয় পার্টির ভাঙনের সূত্র ধরে আরও একটি জোট আত্মপ্রকাশ করেছে। জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান দাবিদার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও আরেক জাতীয় পার্টি জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)’ সম্প্রতি যাত্রা শুরু করেছে।

তবে এই জোট শেষ পর্যন্ত নির্বাচনি লড়াইয়ে নামতে পারবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের মধ্য থেকে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই বলে দাবি তুলেছে।

নবগঠিত ২০ দলের এই জোট মনে করছে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটের একটি অংশ তাদের দিকে আসতে পারে। তবে এতে যুক্ত হওয়া দলগুলো বেশির ভাগই নামসর্বস্ব।

বাম প্রগতিশীল রাজনীতিও নতুন সমীকরণে সক্রিয়। গত মাসে ৯টি দল নিয়ে ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ গঠিত হয়েছে। এসব দলের মধ্যে রয়েছে— সিপিবি, বাসদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের বেশির ভাগ শরিক। আন্দোলন ও নির্বাচনে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তারা স্বতন্ত্র থাকবে নাকি কোনো বড় জোটে যুক্ত হবে— সে সিদ্ধান্ত এখনো স্পষ্ট নয়।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে আন্দোলন করা দলগুলোর সঙ্গে আমরা কথা বলছি। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করি।’

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

তফসিল ঘোষণার পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হচ্ছে স্বচ্ছ নির্বাচন : গোলাম পরওয়ার

তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জামায়াত দেশের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। কিছু গোষ্ঠী হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হুমকি-ধমকি দিয়ে আবার কর্তৃত্ববাদী শাসন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। জনগণ আগামী নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে এসব অপচেষ্টা প্রতিহত করবে।

১৭ ঘণ্টা আগে

দেশ পরিচালনার পরিকল্পনা একমাত্র বিএনপিই দিয়েছে: তারেক রহমান

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলই আগামীর বাংলাদেশ পরিচালনার পরিকল্পনা দেয়নি, একমাত্র বিএনপিই তা দিয়েছে। আগামী নির্বাচনে ধানের শীষকে জেতাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

১৮ ঘণ্টা আগে

বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কেন জোট করেননি— জানালেন নাহিদ

নাহিদ ইসলাম বলেন, “ফলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, মানুষের এই ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে আমরা অন্য কোনো দলের সঙ্গে যদি যাই, আমরা ‘কম্প্রোমাইজড’ হিসেবে বিবেচিত হব। আমরা সেই সমঝোতার রাজনীতি করতে চাই না। আমরা চাই যে আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে আমরা এককভাবে দাঁড়াব। নির্বাচনে ফলাফল যাই আসুক, আমরা জনগণের ক

২১ ঘণ্টা আগে

সিট পাব কি পাব না, সে হিসাব করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি না: নাহিদ

বিভিন্ন দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে নাহিদ বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় মাফিয়াদের নমিনেশন দেওয়া হয়েছে। ঋণ খেলাপিকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে কি না, এর ওপর নির্ভর করবে কমিশন কতটা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় কাজ করছে।’

২১ ঘণ্টা আগে