অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটের যত চ্যালেঞ্জ

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১১: ০১
বাজেট। প্রতীকী ছবি

ক্ষমতা গ্রহণের ১০ মাসের মাথায় প্রথমবার বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। যা আগের বছরের চেয়ে সাত হাজার কোটি টাকা কম।

এবার এমন এক সময়ে এই বাজেট দেওয়া হয়েছে, যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব ঘাটতি, বিদেশি ঋণের কঠোর শর্ত, বিনিয়োগে স্থবিরতাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে প্রথম ঘোষিত বাজেটে এসব সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে নতুন কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটি ঘিরে এক ধরনের বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগের রাজনৈতিক সরকারগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে খুব একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘এবারের বাজেটে বেশকিছু ভালো উদ্যোগ বা প্রত্যাশার কথা বলা হলেও যে কাঠামোতে বাজেট দেওয়া হয়েছে, সেটি পুরোনো। ফলে গতানুগতিক বাজেটের পুঞ্জীভূত সমস্যাগুলো এখানেও রয়ে গেছে। অথচ এই সরকারের সামনে ভিন্নধর্মী একটা বাজেট উপস্থাপনের সুযোগ ছিল, যা তারা সেভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হননি।’

বাজেটে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর পদক্ষেপ না নিয়ে আগের মতোই করদাতাদের করের হার বাড়ানো যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটিরও সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে।’

অন্যান্য বছর জাতীয় সংসদে পেশ করা হলেও এবার সেটি না থাকায় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে বেতার-টেলিভিশনের মাধ্যমে। প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক পাঁচ শতাংশ।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। ইতোমধ্যে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাময়িক হিসাবে তিন দশমিক ৯৭ শতাংশ হয়েছে, যা চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা বাড়তে পারে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি বৃদ্ধি পাবে এবং মধ্যমেয়াদে ৬ দশমিক পাঁচ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আমরা আশা করছি।’

এছাড়া, চলতি বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার সামনের বছর কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নতুন বিনিয়োগসহ অর্থনীতিতে যে ধরনের পরিবর্তন দরকার, সেটি আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

এবারের বাজেটে কমানোর বদলে সার্বিকভাবে অধিকাংশ করদাতার ওপর করের চাপ বাড়িয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে করহারের ধাপে কিছুটা পরিবর্তন এনে সাতটির জায়গায় ছয়টি ধাপে করহার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।

বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, নতুন অর্থবছরে আয়করের হার আগের মতোই থাকছে। তবে পরের দুই বছরের করহারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরে বার্ষিক তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ে কর দিতে হবে না। পরবর্তী তিন লাখ টাকা আয়ে কর দিতে হবে ১০ শতাংশ হারে। কিন্তু যেহেতু কর হিসাব করা হয় আগের বছরের জুলাই মাস থেকে আয়বছর ধরে, ফলে এই জুলাই মাস থেকেই নতুন করের হার প্রযোজ্য হবে।

আগে সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর পাঁচ শতাংশ এবং তার পরের চার লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দেওয়া লাগত।

একইভাবে, এখন ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপরে পরবর্তী ২০ লাখ টাকা আয়ের জন্য ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে, যা আগে সাড়ে ১৮ লাখ টাকার ওপরে পরবর্তী ২০ লাখ টাকা আয়ের জন্য দিতে হতো। আর সাড়ে ৩৮ লাখ টাকার ওপরের পরবর্তী সকল আয়ের জন্য আগে ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো, এখন সেখানে ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপরে সকল আয়ের জন্য ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে আগের বছরের মতো এবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

টিআইবি বলেছে, ‘সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, যা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি।’

তিনি বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগ একই সঙ্গে বৈষম্যমূলক। কারণ, এই সিদ্ধান্তের ফলে আবাসন খাতে অবৈধ অর্থের মালিকদের অধিকতর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সৎ উপার্জনকারীদের ফ্ল্যাট বা ভবনের অংশীদার হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে।’

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিপরীতে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা এবারের বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে, করের আওতা না বাড়িয়ে সরকার যেভাবে করের হার বাড়িয়েছে, তাতে করদাতাদের ওপর চাপ বেড়েছে।

অন্যদিকে, রাজস্ব খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে যে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে, সেটি দ্রুত সমাধান করা না গেলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জিত হবে, সেটি নিয়েও শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস হতে এবং এক লাখ এক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে মেটানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।

এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ।

এটাকেও নতুন বাজেটের একটি বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান।

তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা

ad
ad

ঘরের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

মুজিবনগর সরকারের সবাই মুক্তিযোদ্ধা: উপদেষ্টা ফারুক ই আজম

অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মুজিবনগর সরকারের যারা ছিলেন, তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তবে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে বিবেচিত হবেন।

১৮ ঘণ্টা আগে

মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বদলে অধ্যাদেশ জারি

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরাসরি যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, তাঁদের মধ্যে মুজিবনগর সরকার, বীরাঙ্গনা এবং মুক্তিযুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসকদের সহায়কদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এর বাইরে অন্যদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে রাখা হ

১৯ ঘণ্টা আগে

‘নারীর ১০০ আসন নিয়ে একমত বিএনপি, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দ্বিমত’

সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আগে একসময় ৩০ আসন ছিল, পরে এটা আমরা বৃদ্ধি করে ৪৫ করেছিলাম এবং পরবর্তী লাস্ট সংশোধনের মধ্যে এটা ৫০ আসন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতিটা হচ্ছে আনুপাতিক হারে যাদের যত সদস্য আছে—সেই অনুপাতে সেটা নির্ধারিত হয়। পরে আমরা আরও ৫০টা আসন বৃদ্ধির প্রস্তাব করলাম আমাদের দলের পক্ষ থেকে।

১ দিন আগে

সরকার না পড়ালে নিজেই শপথ নেবেন ইশরাক

সরকার যদি শপথ না পড়ায়, তাহলে নিজেই নেতাকর্মীদের নিয়ে শপথ নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়রের চেয়াবে বসে পড়বেন বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনে ‘বহিরাগত’ কোনো প্রশাসক ও সরকারের উপদেষ্টাকে নগর ভবনে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

১ দিন আগে