কতটা ঐক্য এলো জুলাই সনদে?

নাজমুল ইসলাম হৃদয়
আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ২২: ২৪
শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে জুলাই সনদে সইয়ের পর তা দেখাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

আট মাস ধরে দফায় দফায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত করার পর ২৪টি দল সইও করেছে জুলাই সনদে। উৎসবমুখর পরিবেশে জুলাই সনদ সই হওয়ার মুহূর্তকে ‘অবিস্মরণীয়’ আখ্যা দিয়েছে বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টা সনদ সইয়ের পর দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে আমাদের নবজন্ম হলো।

তবে ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে অভিহিত করলেও যে জুলাই অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে এই সনদ বাস্তব রূপ পেয়েছে, সেই অভ্যুত্থানের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টিই (এনসিপি) এই সনদে সই করেনি। সই করেনি দেশের অন‍্যতম বামপন্থি দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) বাম ধারার আরও তিন দল।

এদিকে জুলাই সনদের প্রস্তাবে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য এসেছে বলা হলেও এর মধ্যে কেবল ১৭টি প্রস্তাবে পূর্ণ ঐকমত্য এসেছে সবগুলো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। বাকি ৬৭টি প্রস্তাবেই কোনো না কোনো দলের দ্বিমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়ে গেছে। এসব ভিন্নমত বাস্তবায়নসহ জুলাই সনদ কার্যকরের প্রক্রিয়া নিয়েও দলগুলোর মধ্যে রয়ে গেছে তীব্র ভিন্নমত। পাঁচ দলের সনদ বর্জনসহ এসব বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে— জাতীয় ঐক্যের এই দলিল কতটা ঐক্য আনতে সক্ষম হলো দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী রাজনীতি ডটকমকে বলেন, সনদে স্বাক্ষর করলেই তো ঐক্য হয় না। এখন অনেকেই হয়তো আইনি ভিত্তির ওপরে জোর দেবে, কেউ হয়তো নির্বাচনে যেতে চাইবে না। যে ধরনের ঐক্য হলে কোনো ঝামেলা ছাড়া নির্বাচন হতে পারত, সে ধরনের ঐক্য এখানে হয়নি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের আরেক সাবেক অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুমও বলছেন একই কথা। রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, জুলাই সনদের প্রক্রিয়া জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়াতে পারল না। জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনিসিপি) যে অংশগ্রহণ করানো গেল না, সেটি নিঃসন্দেহে একটি বিশাল ঘাটতি।

Quote-Of-Prof-Dilara-Chowdhury-On-July-Charter-19-10-2025

যেভাবে প্রণয়ন জুলাই সনদ

গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। প্রথম ধাপে গঠন করা হয় ছয়টি সংস্কার কমিশন— সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এই সংস্কার কমিশনগুলো যেসব প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে উঠে আসা সুপারিশ ও প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে প্রধান উপদেষ্টাকে সভাপতি করে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

এই কমিশন প্রথম পর্বে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৪টি বৈঠক করে। দ্বিতীয় পর্বে ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে ২৩টি বৈঠকের মাধ্যমে ঐক্য প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ প্রক্রিয়াতেই শেষ পর্যন্ত ৮৪টি প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ ঐকমত্য ধরে নিয়ে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হয়।

জুলাই সনদে রাষ্ট্র সংস্কারের যে ৮৪ প্রস্তাব করা হয়েছে তার মধ্যে ৪৭টি বিষয়কে ‘সংবিধান সংশোধন সাপেক্ষে সংস্কার’ এবং বাকি ৩৭টি বিষয়কে ‘আইন বা অধ্যাদেশ, বিধি ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংস্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ঐকমত্য কমিশন।

Quote-Of-Prof-Latif-Masum-On-July-Charter-19-10-2025

সনদ সই তবু অমীমাংসিত

জুলাই সনদের চূড়ান্ত কপি হাতে পাওয়ার পরই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে আপত্তি আসতে থাকে। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলেরই মূল উদ্বেগের জায়গা ছিল— সনদের যেসব প্রস্তাবনায় ‘নোট অব ডিসেন্ট’ এসেছে, সেগুলো নিরসন করা হবে কীভাবে। সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬৭টিতেই এ ধরনের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকায় সে প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে। এনসিপিসহ একাধিক দল এ বিষয়টি বারবার স্পষ্ট করার আহ্বান জানালেও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ইস্যু অমীসাংসিতই রয়ে গেছে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার জন্য গণভোট আয়োজনে একমত হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো। তবে সে গণভোট কবে আয়োজন করা হবে, গণভোটে জুলাই সনদের জন্য কী ধরনের রায় জনগণের কাছ থেকে নেওয়া হবে— এ সব ইস্যুও শেষ পর্যন্ত মীমাংসা হয়নি।

এদিকে জুলাই সনদের পটভূমিতে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলেছে বামপন্থি চার দল সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ। সংবিধানের তফসিল থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়ার প্রস্তাবনার বিরোধিতাও করেছে এই চার দল ও গণফোরামসহ আরও কয়েকটি দল। তাদের আপত্তির মুখে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়ার প্রস্তাবটি বাতিল করা হলেও বাকি বিষয়গুলো নিরসন হয়নি।

এদিকে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই আইনি ভিত্তি নিয়েও দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিন্নমত। এনসিপি সরাসরি জানিয়েছিল, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত না হলে তারা এ সনদে সই করবে না। হয়েছেও তাই, তারা সনদে সই করেনি। এমনকি সনদ সইয়ের অনুষ্ঠানও বর্জন করেছে।

এনসিপির মতোই জুলাই সনদ সইয়ের অনুষ্ঠান বর্জন করছে আপত্তি তোলা চার বামপন্থি দলও। তারাও জুলাই সনদে সই করবে না বলে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। সব মিলিয়ে ঐকমত্য কমিশনের তালিকায় থাকা ৩০টি দলের মধ্যে অনুষ্ঠানের দিন জুলাই সনদে সই করেছে ২৪টি দল। পরে আজ রোববার (১৯ অক্টোবর) গণফোরামও সনদে সই করেছে। বাকি পাঁচটি দল জুলাই সনদে সই করেনি।

যে কারণে সনদে সই করেনি এনসিপি ও ৪ বাম দল

‘নোট অব ডিসেন্ট’ ও গণভোটসহ আইনি ভিত্তি নিয়ে সংশয় থেকে জুলাই সনদে সই করেনি এনসিপি। এই সনদের চূড়ান্ত কপি রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়ার পর গত বুধবার সন্ধ্যায় ফের দলগুলোকে ‘অতি জরুরি’ বৈঠকে ডেকেছিল ঐকমত্য কমিশন। সেখানে দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সনদে বিভিন্ন দলের উত্থাপন করা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ যেভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেই পথনকশা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। গণভোটের প্রশ্ন এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।

পরদিন বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া এবং সনদ বাস্তবায়নে আদেশের ব্যাপারে নিশ্চয়তা ছাড়া যদি সনদে সই করি, সেটা মূল্যহীন হবে। পরের সরকার এলে সনদ নিয়ে কী করবে, সে নিশ্চয়তা আমরা চাই। সে বিষয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা জুলাই সনদের সইয়ের যে অনুষ্ঠান বা যে আয়োজন চলছে, সেখানে আমরা নিজেরা অংশীদার হব না।

পরে রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় এনসিপি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করে, স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে (জুলাই সনদের) আইনি ভিত্তি অর্জন হবে না, এটা কেবল আনুষ্ঠানিকতা। আমরা বহুবার আইনি ভিত্তির কথা বলেছি। তাই এখানে অংশ নিচ্ছি না।

সনদ সইয়ের দিন শুক্রবারই এক অনুষ্ঠানে নাহিদ বলেন, আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির উল্লেখ ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। সনদ সইয়ের পর দলটির এক বিবৃতিতেও একই কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে জুলাই সনদের বিভিন্ন প্রস্তাবনা নিয়ে আপত্তি ছাড়াও তাদের মতামতকে উপেক্ষা করার অভিযোগ তুলেছে চার বাম দল। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে লিখিতভাবে তারা জুলাই সনদে সই না করা ও সইয়ের অনুষ্ঠান বর্জনের পেছনে তাদের অবস্থানের ব্যাখ্যা দেয়। তাতে জুলাই সনদে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপন না হওয়া ও তাদের সংশোধনীকে উপেক্ষা করা ছাড়াও আরও ছয়টি কারণ তুলে ধরা হয়েছে।

সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ বলছে, প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, সব দল যেসব বিষয়ে একমত হবে, শুধুমাত্র সেগুলোকেই ঐকমত্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু ১৪ অক্টোবর আমাদের কাছে পাঠানো চূড়ান্ত সনদে দেখা যায়, সর্বসম্মত নয় এমন প্রস্তাবগুলোও যুক্ত করা হয়েছে এবং আমাদের দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

সই না করা ও বর্জনে কতটা ঐক্য এলো?

পাঁচ দলের সই না করা ও অনুষ্ঠান বর্জনের মধ্য দিয়ে জুলাই সনদে কতটা ঐক্য এলো— এমন প্রশ্নে সনদে সই করা দলগুলোসহ ঐকমত্য কমিশনের উত্তর একরকম, অন্যদিকে ভিন্ন উত্তর মিলেছে সনদে সই না করা দলগুলোসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।

জুলাই সনদ সইয়ের অনুষ্ঠানে এই সনদ প্রণয়নে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি নয়। এ হচ্ছে নাগরিকের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং রাষ্ট্রের একটি সামাজিক চুক্তি। নাগরিকদের মতামতের মধ্য দিয়ে এই দিক নির্দেশক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ভবিষ্যতে পরিচালনা করবে। কিন্তু আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে।’

জুলাই সনদের প্রস্তাবনা নিয়ে এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতা প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, রাজনীতিতে মতপার্থক্য না থাকলে তা গণতান্ত্রিক হয় না। কিন্তু ঐক্যের জায়গাও থাকতে হবে। যেন আমরা বলতে পারি, আমাদের অনেক স্রোত, মোহনা একটি— একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তৈরি করা। আমাদের বহু স্রোত, কিন্তু সবাই এক জায়গায়— আমরা যেকোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাই দাঁড়িয়ে থাকব।

একই অনুষ্ঠানে ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে একমত হয়েছি যে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেভাবেই দেশকে পরিচালনা করা, দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, সেটি কীভাবে আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়, তার জন্যই এই সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে। আজ এই জুলাই জাতীয় সনদ সইয়ের মাধ্যমে আমাদের নবজন্ম হলো।

জুলাই সনদ সইয়ের সময়কে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর মাধ্যমে ঐক্যের বার্তা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যে সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তার আরেকটা নিদর্শন আজ দেখা গেল। জাতির প্রয়োজনে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সব দল যে এক হয়ে কাজ করতে পারে, সেটারই প্রমাণ মিলল।’

জুলাই সনদে সই করছে রাজনৈতিক দলগুলো। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
জুলাই সনদে সই করছে রাজনৈতিক দলগুলো। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

জুলাই সনদের বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল জামায়াতে ইসলামীর। তবে তারাও জুলাই সনদে সই করেছে। এখন এই সনদের দ্রুত বাস্তবায়ন ও এর আইনি ভিত্তি চাইছে তারা। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সনদ সইয়ের পর প্রতিক্রিয়া বলেন, ‘আজকের স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা সনদে একমত হয়েছি, তবে এর আইনি ভিত্তি এখনো বাকি রয়েছে। সরকারের উচিত তা দ্রুত নিশ্চিত করা।’

বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিমত থাকলেও এর আগে জুলাই সনদে সই করার কারণ ব্যাখ্যা করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক রাজনীতি ডটকমকে বলেছিলেন, ‘আমরা একটি কেন্দ্রীয় বোঝাপড়া ও রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি করার লক্ষ্যে অনেক প্রশ্নে ছাড় দিয়েছি। আমরা এটাও উপলব্ধি করেছি, এক যাত্রায় সব অর্জন সম্ভব নয়। কিছু বিষয়ে আপত্তি ও মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা এমন ঐকমত্যে পৌঁছেছি— যতদূর সম্ভব আলোচনা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।’

বিপরীতমুখী বক্তব্য এসেছে জুলাই সনদে সই না করা দলগুলোর কাছ থেকে। সনদ সইয়ের পরদিন এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এনসিপি জুলাই সনদকে স্রেফ রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল মনে করে না। এই সনদের মূল কাজ হবে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে গণতান্ত্রিক রূপান্তর আনা। তাই আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি ছাড়া এই সনদে সই করা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা।’

দলের আরেক নেতা সামান্তা শারমিন একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, জুলাই সনদের যে বাস্তবায়ন পদ্ধতি, সেটার বিষয়ে যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, এই মতপার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য ঐকমত্য কমিশন যে ধরনের ভূমিকা নিয়েছে, এই ভূমিকার চেয়ে আমরা দেখতে চেয়েছিলাম আমূল পরিবর্তন ও গুণগত পরিবর্তনের দিকে ঐকমত্য কমিশনের একধরনের ঝোঁক থাকবে। তার বদলে আমরা দেখতে পেয়েছি, বাহাত্তরের সংবিধানকে অবিকল রেখে গণঅভ্যুত্থানকে বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার এক ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে।’

প্রকৃতই জাতীয় ঐক্য গড়তে ও দৃঢ়তর করতে চাইলে বহুদলীয় ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘বাকশালি কায়দায় চিন্তা করলে হবে না। আমাদের ঐক্য আসবে বৈচিত্র্যের ভেতর থেকে। ভিন্ন মত, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্ন ভাবনার মানুষ একসঙ্গে কাজ করলেই প্রকৃত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মতের মিল থাকবে, অমিলও থাকবে— এই বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি।’

জুলাই সনদে প্রকৃত ঐক্য আসেনি উল্লেখ করে সিপিবির সাবেক এই সভাপতি বলেন, “মতের পার্থক্য আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে মীমাংসা করতে পারি। গণতান্ত্রিক সমাধানের একমাত্র পথ হলো জনগণ, তাদের কাছেই বারবার ফিরে যেতে হবে, তাদের মতামতই চূড়ান্ত। কিন্তু সেটি না করে যেটিকে ‘ঐক্যমতের দলিল’ বলা হচ্ছে, সেখানে বহু ভিন্নমতকে কেবল আলাদা বন্ধনীর মধ্যে রেখে সামান্য সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়েছে, যা প্রকৃত ঐক্যের প্রতিফলন নয়।’

Quote-Of-Mujahidul-Islam-Selim-On-July-Charter-19-10-2025

যা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা

বিএনপি জুলাই সনদে সই করলেও জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির প্রবর্তন নিয়ে তাদের তীব্র দ্বিমত রয়েছে। তাদের পক্ষে রয়েছে বেশ কিছু দল। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি দল আবার পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে অনড় অবস্থান নিয়েছে।

অন্যদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোটের তারিখ নিয়েও রয়েছে দ্বিমত। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো চায়, জাতীয় নির্বাচনের দিনেই জুলাই সনদের গণভোট হোক। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য কয়েকটি দলের দাবি, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে নভেম্বরের মধ্যে গণভোট হতে হবে।

এ ধরনের মতপার্থক্যগুলো ভবিষ্যতে বড় রাজনৈতিক সংঘাত তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, জুলাই সনদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। কিন্তু এটি ঐক্যমতের দলিল হিসেবে যে বার্তা দিতে চেয়েছিল, সে জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে। আইনি ভিত্তি বনাম রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, ইতিহাসের স্বীকৃতি বনাম বাস্তব ক্ষমতার সমঝোতা এবং অংশগ্রহণমূলক ঐকমত্য বনাম প্রক্রিয়াগত ঐক্য— এই তিনটি অক্ষে স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘অনেকগুলো দল জুলাই সনদে সই করলেও আসল যে ইস্যু, অর্থাৎ এই সনদের আইনি ভিত্তি, সেটি এখনো নিশ্চিত হয়নি। এ বিষয়টি যতক্ষণ পর্যন্ত পরিষ্কার না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সনদটির তেমন কোনো মূল্য নেই।’

তিনি আরও বলেন, “এ নিয়ে অনেক ধরনের ইস্যুই হতে পারে। সনদে সই করা দলগুলোর ভেতরে এখনো আইনি ভিত্তি নিয়ে দ্বিমত হতে পারে। ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলো কীভাবে ডিল করা হবে, সে বিষয়েও দ্বিমত হতে পারে। ফলে এই সনদকে ঐক্যের চূড়ান্ত দলিল বলা যায় না।”

অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুমের কাছেও জুলাই সনদে সইয়ের অনুষ্ঠান শেষ পর্যন্ত হতাশাজনক মনে হয়েছে। রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘সংসদের বাইরে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেল, মামলা হলো। বিনা ইন্ধনে তো এমন কিছু ঘটেনি। নিশ্চয়ই এখানে কিছু ষড়যন্ত্র রয়েছে। দেশের সাধারণ জনগণ, যারা শান্তিতে থেকে উৎসব আর আনন্দের সঙ্গে জুলাই সনদ উদযাপন করতে চেয়েছিল, তাদের জন্য বিষয়টি অনেকটা হতাশাজনকই হলো।’

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

সুস্থ থাকলে নির্বাচনী প্রচারে নামবেন খালেদা জিয়া: রিজভী

শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিতে বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনা হচ্ছে, সুস্থ থাকেলে নির্বাচনী গণসংযোগে অংশ নেবেন বলেও জানান তিনি।

৭ ঘণ্টা আগে

সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের যোগ্যতা নেই ইসির : হাসনাত

এনসিপির এই নেতা অভিযোগ করে বলেন, ‘বর্তমান ইসি নুরুল হুদা কমিশনের মতো পথেই হাঁটছে। আমরা চাই না এই কমিশনেরও সেই পরিণতি হোক। তাদের আচরণে কোনো স্বচ্ছতা নেই, আর সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করারও কোনো সক্ষমতা দেখা যাচ্ছে না।’

৭ ঘণ্টা আগে

নির্বাচন কমিশন 'জংলি কায়দায়' চলছে: নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী

তিনি অভিযোগ করেন, ‘নির্বাচন কমিশনাররা যেখান থেকে আসছে, তারা তাদের নিয়োগদাতাদের স্বার্থই রক্ষা করছে। অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে নির্বাচন কমিশনকে মুক্ত করতে হবে।’

৯ ঘণ্টা আগে

আমার বক্তব্য নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা হয়েছে: সালাহউদ্দিন

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমি মনে করি না আমার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে, তবে এনসিপি হয়তো আংশিকভাবে বক্তব্য কেটেছে। কারণ আমি স্পষ্টভাবে বলেছিলাম, ওখানে কোনো প্রকৃত জুলাই যোদ্ধা এই সংঘর্ষে জড়িত নয়।’

৯ ঘণ্টা আগে