ডিসেম্বরেই কেন নির্বাচন চায় বিএনপি?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ১৩: ৩৪
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস (বাঁয়ে) ও তারেক রহমান। ছবি: সংগৃহীত

দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে অনেক আগেই। ধীরে ধীরে সে দাবি রূপ নিতে শুরু করেছে আলটিমেটামে। সবশেষ ঢাকার নয়াপল্টনে এক সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সরকারও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আগের অবস্থানেই অনড় রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বারবারই বলে আসছেন, ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে নির্বাচন। সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসহ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবও বারবার একই বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সবশেষ জাপান সফরেও দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাপান-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফ্রেন্ডশিপ লিগের (জেবিপিএফএল) সভাপতি তারো আসোর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন।

এ অবস্থায় নয়াপল্টনে বিএনপির বুধবারের (২৮ মে) সমাবেশ থেকে তারেক রহমানের আলটিমেটামের সুরে দেওয়া বক্তব্যকে নির্বাচন প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর কৌশল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে একই সঙ্গে এ প্রশ্নও উঠেছে— ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের জন্য কেন চাপ বাড়াতে চাইছে বিএনপি? কতটাই বা চাপ তৈরি করতে পারবে তারা?

নির্বাচনের সময় ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে নেই জুলাই গণঅভ্যত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কিংবা জামায়াতে ইসলামী। এসব দল বরং নির্বাচন নিয়ে সরকারের টাইমলাইনের ওপরই আস্থা রেখে চলেছে। ফলে নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়ে এগোতে গিয়ে রাজনীতিতে বিএনপি একা হয়ে পড়বে কি না, এ প্রশ্নও আলোচনায় রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

এদিকে বিএনপিও অভিযোগ করছে, অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপি ও সেনাবাহিনীকে প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা করছে। তবে সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বললে তারা এ ধরনের অভিযোগ মানতে রাজি হননি।

সার্বিক পরিস্থিতিতে বিএনপির অবস্থান সরকারের সঙ্গে মুখোমুখি হলেও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ডিসেম্বরেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দেশের মানুষের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন, বাধ্য না হলে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবে না। এমনকি সরকার ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে চায় না বলে তারা মনে করেন। সে কারণে সরকারকে বাধ্য করানোর চেষ্টা তাদের থাকবে।

এর মধ্যে অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ইচ্ছার কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে তা ব্যাপক আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেয়। প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে সম্ভাব্য সংকট নিয়েও আলোচনা হয় নানা মহলে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে গত শনি ও রোববার দুই দিনে ২২টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। সরকার বলছে, দলগুলোর সঙ্গে এ আলোচনায় সংকট নিরসন হয়েছে।

তবে রাজনীতিবিদদের অনেকে ও বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতত উত্তেজনা থেমেছে। কিন্তু এই সরকারের অংশীজনদের মধ্যে বড় দুই শক্তি বিএনপি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব কমেনি, অস্বস্তি রয়ে গেছে।

কেন চাপ বাড়াতে চাইছে বিএনপি

নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে— এ ধারণা কেবল বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যেই নয়, দেশের রাজনীতির অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে ভোটের মাঠে অন্য কোনো দলকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে না বিএনপি। বাকিরাও এ ধারণার সঙ্গে একমত। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে তৈরি হওয়া সুযোগ বা সম্ভাবনা দ্রুত কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় বিএনপি।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, বিএনপি এরই মধ্যে ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে— এমন চিন্তার কারণেই রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত দলটির নেতাকর্মীদের অনেকে আধিপত্য বিস্তার, দখল, চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এ ধরনের অপরাধে জড়িত নেতাকর্মীদের অনেককে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং এমনকি বহিষ্কার করাসহ সাংগঠনিক বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু থামানো যায়নি বিএনপির নেতাকর্মীদের দখল, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ।

এ পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপি সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিয়েছে। অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে দলটিকে। নেতাকর্মীদের এ সব অপরাধের অভিযাগ নিয়ে চিন্তিত বিএনপির নেতৃত্ব।

তারা মনে করছেন, নির্বাচন আয়োজনে যত দেরি হবে, দলের নেতাকর্মীদের সামলানো তত কঠিন হবে। দখল, চাঁদাবাজি ও অধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা বা এ ধরনের অপরাধও বাড়তে থাকবে।

এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন দেরিতে হলে কতটা সহায়ক পরিস্থিতি থাকবে, সেটা দলটিকে ভাবাচ্ছে। হয়তো তারাই ক্ষমতায় যাবে, কিন্তু সমালোচনা বাড়বে।

ষড়যন্ত্র তত্ত্বও কাজ করছে বিএনপির ভেতরে। দলটির নেতারা মনে করছেন, এনসিপির প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের দুর্বলতা বা পক্ষপাতিত্ব আছে। এই দলটি সংস্কার ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার শেষ করার পর নির্বাচন চায়। আবার জামায়াত সুবিধাবাদী অবস্থান নিচ্ছে। এই দুটি দলের সঙ্গে ইসলামপন্থি আরও কিছু দলকে এক অবস্থানে এনে সরকার বিএনপিকে প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা করছে— এমন ষড়যন্ত্রের অভিযোগও বিএনপি আনছে।

তবে জামায়াাত ও এনসিপি এমন অভিযোগ মানতে রাজি নয়। জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বিবিসিকে বলেন, আগামী বছর রোজার আগ বা পরে নির্বাচন চান তারা। তাদের এ অবস্থানকে ভিন্নভাবে দেখা ঠিক হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ভোট হলেই বিএনপির ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত— এ বাস্তবতার পরও বিএনপিকে ঠেকানো যায় কি না— এ ধরনের ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা রয়েছে বলেও বিএনপি নেতারা বিশ্বাস করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ক্ষমতায় থাকার লোভ তৈরি হয়েছে, সেজন্য নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা রয়েছে— এমন ধারণা থেকে বিএনপি নেতারা এখন সরকারের সমালোচনা করছেন।

বুধবার ঢাকায় বিএনপির আয়াজনে তারুণ্যের সমাবেশে বিএনপি নেতা তারেক রহমান বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মনে হয় এরই ভেতরে টালবাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের অভিনব শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যত।’

তারেক রহমান আরও বলেন, ‘জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ও বাইরে কারও কারও মনে হয় ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।’ অন্তর্বর্তী সরকাররে দুর্বলতার বিষয়কেও বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাওয়ার পেছনে যুক্তি হিসেবে দেখাচ্ছে।

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে বলে মনে করে বিএনপি। সেই ব্যর্থতা ঢাকতে সরকারও ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ আওড়াচ্ছে বলেই নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তা কাজ করছে— এমনও মনে করেন বিএনপি নেতাদের অনেকে।

এসব কারণেই বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকাররে ওপর চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়ে এবার মাঠে নামছে।

বিএনপি কি একা হয়ে পড়ছে?

ভোটের সময় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে অন্য দলগুলোর যে মতপার্থক্য ছিল, তা এখন বাড়ছে। কারণ ডিসেম্বরেই নির্বাচন করতে হবে— এ অবস্থানে নেই জামায়াত, এনসিপি বা ইসলামপন্থি বেশির ভাগ দল। অন্তর্বর্তী সরকারও ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে চায় না।

সব দলই নির্বাচন ও এর রোডম্যাপ চায়। কিন্তু নির্বাচনের সময়ের প্রশ্নে বিএনপি ছাড়া অন্য এসব দল ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করার সরকারের অবস্থানের প্রতি সমর্থন দিচ্ছে। বামপন্থি কিছু দল বিএনপির সঙ্গে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। তবে রাজনীতিতে এখন বামপন্থি দলগুলোর তেমন প্রভাব নেই বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এনসিপি, জামায়াত ও ইসলামপন্থি দলগুলাকে ঐক্যবদ্ধ করে বিএনপিকে কোণঠাসা করা বা তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করনোর চেষ্টা রয়েছে বলে যে আলোচনা রাজনীতিতে চলছে, সেটি বিএনপিও বিবেচনায় নিচ্ছে। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা রাজনীতিতে একা হয়ে পড়লেও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য তারা সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

সরকারকে কতটা চাপে ফেলতে পারবে বিএনপি?

অন্তর্বর্তী সরকারের অংশীজনদের মধ্যে নিজেকে বড় শক্তি হিসেবে দেখে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, অংশীজনদের বড় দুই শক্তি বিএনপি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তারা যদি সরকারকে সহযোগিতা না করেন, তাহলে সরকার চাপে পড়বে। কারণ সরকারের টিকে থাকার প্রশ্ন আসবে।

এ ধরনের চিন্তা থেকে গত কয়েকদিনে বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার একটি বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে— সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ না দিলে তাদের পক্ষে সরকারকে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ সহযোগিতা না করার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। ফলে দলটি সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে সহযোগিতা না করার ঘোষণাও দিতে পারে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, তারা সমাবেশ-গণজমায়েতের মতো গণতান্ত্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে চান।

দলটির ধারণা, অন্তর্বর্তী সরকারর বাধ্য না হলে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবে না। ফলে সরকারকে বাধ্য করার চেষ্টাও থাকবে বিএনপির।

জুনের মধ্যে নির্বাচনের পুরনো অবস্থানেই সরকার

ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে বলে বিএনপির শীর্ষ নেতা যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন করার পুরোনো অবস্থানই তুলে ধরেন।

তবে তাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তায় এটা মনে হয়েছে, সরকার আগামী বছরের আগে অর্থাৎ ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে চায় না। এ ধারণা বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও রয়েছে।

কারণ প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনা নিয়ে যে সংকট হয়েছিল, সে পটভূমিতে গত শনি ও রোববার অধ্যাপক ইউনূস বিএনপিসহ দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠক সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা ও এ সরকার আগামী বছরের ৩০ জুনের পর একদিনও ক্ষমতায় থাকবেন না।

এ বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন সরকার করবে না— প্রেস সচিবের ওই বক্তব্যে সেটা পরিষ্কার বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

এদিকে বুধবার যখন বিএনপির সমাবেশ থেকে আলটিমেটামের সুরে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাওয়া হয়েছে, সেদিনই জাপান সফরে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা আবারও ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের পুরোনো অবস্থানই তুলে ধরেছেন।

লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত এ সরকার যদি কিছু সংস্কার করতে না পারে, তাহলে সরকারের মুখ রক্ষা হবে না। সে কারণে সরকার হয়তো প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কারের জন্য সময় হাতে রেখে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছে।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স সাড়ে ৯ মাস পার হয়েছে। এ সময়ে সংস্কার কাজ কিছুই হয়নি বলেও অভিযোগ আছে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়ও সরকার বলেনি বা রোডম্যাপ দেয়নি। সে কারণেই বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও অন্য অংশীজনদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এখনো সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না। এমন প্রেক্ষাপটেই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি সংকট তৈরি হয়েছিল।

সংকটের সমাধান হয়েছে কি?

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনার বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল গত ২২ মে।

এর আগের সপ্তাহে আদালতের রায় অনুযায়ী বিএনপি তাদের একজন নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণার দাবিতে রাস্তায় অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে রাজধানী কার্যত অচল করে দিয়েছিল।

ওই সময় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বৈঠকে বলেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত।

এই দুটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে এনসিপির নাহিদ ইসলামকে ডেকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা তার পদত্যাগের ভাবনা কথা জানানোর ক্ষেত্রে দলগুলোর অসহযোগিতার বিষয় তুলে ধরেছিলেন। নাহিদ ইসলামের মাধ্যমে তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়।

এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং উত্তেজনা তৈরি হয়। সেই পরিস্থিতি সামলাতে অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত সভা করে এক বিবৃতিও দেওয়া হয়েছিল।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ওই সব পদক্ষেপে সরকার একটু শ্বাস নেওয়ার সময় পেয়েছে। আপতত উত্তেজনা কমেছে। কিন্তু পর্দার আড়ালে অস্বস্তি রয়েছে। কারণ সরকারের সঙ্গে বিএনপি ও সেনাবাহিনীর দূরত্ব কমেনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান মনে করেন, সরকার তাদের অংশীজনদের মধ্যে বড় দুই শক্তি বিএনপি ও সেনাবাহিনীকে ধমক দিয়েছে। ফলে উত্তেজনা ও অস্বস্তি রয়ে গেছে।

এমন বক্তব্যের পেছনে উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে থাকা বক্তব্যের কথা উল্লেখ করেন জাহেদ উর রহমান। বিবৃতিতে বলা হয়, যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্য ও কর্মসূচি দিয়ে যেভাবে স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে তোলা হচ্ছে এবং জনমনে সংশয় ও সন্দেহ তৈরি করা হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বৈঠকে।

সরকারের এই দুই বক্তব্যে ধমক দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি নেতারাও মনে করেন। বিএনপির মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, সংকট এখন থমকে আছে, যা আরও প্রকটভাবে দেখা দিতে পারে।

সন্দেহ-অবিশ্বাস বেড়েছে

ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদে থাকা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম এবং এই দুজনের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তাা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের পদত্যাগ দাবি করেছে বিএনপি। কিন্তু বিএনপি নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে রাখা হয়। এর মাধ্যমে বিএনপিকে কী বার্তা দেওয়া হলো, তা নিয়ে দলটির ভেতরে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে এবং সরকারের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস বেড়েছে।

দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে বৈঠকে উপস্থিত রাখার রাজনৈতিক অর্থ রয়েছে। সরকার বিএনপির দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, এটি হতে পারে।

বিএনপি নেতারা ঘটনাটিকে সরকারের ‘ঔদ্ধত্য’ বলে বর্ণনা করছেন। বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেনি দলটি। নেতারা মনে করেন, সরকার বিএনপি ও সেনাবাহিনীর ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে এগোচ্ছে। সে কারণে সাময়িক উত্তেজনা কমলেও দেশের মানুষকেও স্বস্তি দিতে পারছে না পরিস্থিতি। যদিও এ ধরনের বক্তব্য মানতে রাজি নন সরকারের উপদেষ্টারা।

অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার হাত দিচ্ছে, যেগুলো বিতর্ক ছড়িয়েছে। সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংশোধন করায় সচিবালয়ে কর্মকর্তা কমচারীরা পর্যন্ত আন্দোলনে নেমেছেন। রাজনীতিকরা মনে করছেন, সব ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন এক ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। এর মধ্যে যেহেতু সরকারের বড় অংশীজনদের মধ্যে সরকারকে ঘিরে সন্দেহ, অবিশ্বাস রয়ে গেছে। ফলে অস্থিরতা বা উত্তেজনা আবারও বাড়তে পারে।

এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে নির্বাচন করতে হলে সরকার ও অংশীজনদের সব পক্ষের সমঝোতা প্রয়োজন বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

[বিবিসি বাংলা অবলম্বনে]

ad
ad

ঘরের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকার ব্যর্থ : মুজিবুল হক চুন্নু

তিনি আরো বলেন, দেশের মানুষ নিজের ঘরে নিরাপদে থাকতে পারবে না। গতকাল রাতে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের রংপুরে নিজ বাসভবনে অবস্থান করছিলেন, তখন এনসিপি নামধারী কিছু সন্ত্রাসী তার বাসভবনে সন্ত্রাসী হামলা করে জানালার গ্লাস ভাঙচুর করে একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। একটি ছাত্র জনতার গণঅভ্য

১০ ঘণ্টা আগে

সব গণতান্ত্রিক দলই ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়: ১২ দলীয় জোট

জোটের নেতারা বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই দেশের মুক্তি ও উন্নয়নের একমাত্র পথ। অতীতে বারবার তা প্রমাণিত হয়েছে।

১২ ঘণ্টা আগে

বাংলাদেশের সংস্কার কার্যক্রমে পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত জাপানের প্রধানমন্ত্রীর

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করে বৈঠকে দুপক্ষই দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। তারা সবার জন্য শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক (এফওআইপি) অঞ্চলের জন্য তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বি

১২ ঘণ্টা আগে

অধ্যাপক ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিলো জাপানের সোকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করেছে জাপানের সোকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১২ ঘণ্টা আগে