গোপালগঞ্জের ঘটনা 'অশনি সংকেত', বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যদের উদ্বেগ

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৫, ১২: ৩৫
এনসিপির সমাবেশ ঘিরে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল গোপালগঞ্জ। ছবি: ফোকাস বাংলা

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচিকে ঘিরে সহিংতা ও হতাহতের ঘটনা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এই ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

গোপালগঞ্জে গত বুধবারের (১৬ জুলাই) সংঘাত-সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচজনে দাঁড়িয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) দিবাগত রাত দুইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গুলিবিদ্ধ রিকশাচালক রমজান মুন্সী (৩২)।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমে ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। পরিস্থিতি অনুকূলে না আসায় বুধবার রাত আটটা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ দেয় সরকার। পরবর্তীতে আজ শুক্রবার বেলা ১১টা পর্যন্ত কারফিউ বাড়ানো হয়। তিন ঘণ্টা বিরতির পর দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ কারফিউ চলবে।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলছেন, গোপালগঞ্জের সহিংসতা কিংবা পুরোনো ঢাকায় ব্যবসায়ী হত্যার মতো ঘটনাগুলো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এটি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকেই নতুন মাত্রা দিচ্ছে। এসব ঘটনা আসন্ন নির্বাচন পেছানোর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।

এই ঘটনার পেছনে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নেতাদেরও দায় দিচ্ছেন অনেকে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের কারো কারো মতে, 'মার্চ টু গোপালগঞ্জ' নাম দেওয়ার মাধ্যমে এনসিপির নেতারাও পরোক্ষভাবে এই হামলা-সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছেন।

সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। রাজনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বহীন আচরণ একদিকে আওয়ামী লীগকে যেমন লাভবান করেছে, তেমনি যারা নির্বাচন পেছাতে চায়, তারাও একটা সুযোগ পেয়ে যাবে।

এই ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথে একটি 'অশনি সংকেত' বলেও মনে করেন অনেক রাজনীতিবিদ।

পহেলা জুলাই থেকে দেশব্যাপী শুরু হওয়া 'দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা' কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার 'মার্চ টু গোপালগঞ্জ' কর্মসূচি ঘোষণা করে এনসিপি। তাদের এই কর্মসূচিকে ঘিরে ওইদিন রাত থেকেই জেলাটিতে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এরপরও বুধবার সমাবেশের আয়োজন করা হয় গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক এলাকায়। কিন্তু এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা সেখানে পৌঁছানোর আগেই সমাবেশস্থলে হামলার ঘটনা ঘটে।

সমাবেশ শেষে ফেরার পথে গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে আবারও হামলার মুখে পড়ে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়িবহর। পরবর্তীতে যা রূপ নেয় সহিংস সংঘাতে। কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় গোপালগঞ্জ ছেড়ে খুলনার দিকে রওয়ানা দেন এনসিপির নেতারা।

এদিন দুপুর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হামলাকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে ঘটে হতাহতের ঘটনা। এই হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। সম্মিলিতভাবে শাহবাগ ব্লকেড করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, জাতীয় নাগরিক পার্টি, যুবশক্তিসহ ছাত্র-জনতা।

এমন একটি সময়ে এই ঘটনা ঘটলো যখন সংস্কার, জুলাই সনদ ও নির্বাচন ঘিরে নানা আলোচনা চলছে দেশের রাজনীতিতে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ কাটেনি।

গোপালগঞ্জের ঘটনায় নানা প্রতিক্রিয়া এসেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) দেশজুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে এনসিপি। আলাদা কর্মসূচি থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল।

ঘটনার দিন রাতেই জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় গোপালগঞ্জের উদ্ভুত পরিস্থিতিকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার নীলনকশা বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। রাজনৈতিক দলগুলোকে সর্তকতার সঙ্গে কর্মসূচি নির্ধারণের আহ্বানও জানিয়েছে তারা।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে ব্যাহত করতে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। এতে মব সহিংসতা, হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অযোগ্যতা ও নির্লিপ্ততা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ফ্যাসিবাদি শক্তি ঠিক গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির মাথায় যে দুঃসাহস দেখিয়েছে এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। আমরা আশা করি নাই যে, গণঅভ্যুত্থানের শক্তিকে এতো শিগগিরই এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। সেটা গোপালগঞ্জে হোক বা অন্য কোথাও।

এর কারণ হিসেবে সরকারের নির্লিপ্ততাকেই দায়ী করেন সালাহউদ্দিন। তার মতে, 'সরকারের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।'

গোপালগঞ্জে সহিংসতার দায় অন্তর্বর্তী সরকারকেই দিচ্ছেন কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সও। তিনি বলেন, 'গণঅভ্যুত্থানের পরে দেশের স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে নানা অপচেষ্টা চলছে, যা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে।'

এখান থেকে সরকারকে শিক্ষা নিতে বলছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। যারা পুলিশের ওপর হামলা করেছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা।

এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার পথ তৈরি হচ্ছে বলেই মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। আবার, এনসিপি নেতাদেরও গোপালগঞ্জের ঘটনার দায় দিচ্ছেন তিনি। সাইফুল হক বলেন, 'তারা (এনসিপি নেতারা) অন্যগুলোয় (জেলায়) যাচ্ছে গণসংযোগ, গণসমাবেশ (নাম দিয়ে)। এটাতে নাম দিয়েছে মার্চ টু গোপালগঞ্জ। পরোক্ষাভাবে এক ধরনের উস্কানি এর মধ্যে কাজ করছে।'

একটি বিশেষ অঞ্চলের পরিস্থিতি, মানুষের রাজনৈতিক সামাজিক মনস্তত্বসহ অনেকগুলো বিষয় কাজ করে, যা বিবেচনায় রাখা উচিৎ ছিল বলেও মনে করেন তিনি। 'মুজিববাদের কবর দিতে হবে - এই কথাটা গোপালগঞ্জে যেয়ে বলতে হবে কেন?,' প্রশ্ন তোলেন সাইফুল হক।

তার মতে, পুরোনো ঢাকায় ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপিকে ঘিরে একটা অপপ্রচার চালানো হচ্ছিল। এই ধরনের ঘটনাগুলো নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।

খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এমন শঙ্কা থাকার পরও সরকার আগে থেকেই কেন কার্যকর পদক্ষেপ নিল না- এ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেক রাজনৈতিক নেতা।

সাইফুল হক বলেন, 'তারা (এনসিপি নেতারা) তো এক ধরনের পরোক্ষ সরকারি প্রটোকলেই সারাদেশে যাচ্ছেন। এখানেও নিশ্চয় সরকারের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে, একটা উত্তেজনা আগে থেকেই আছে। তার মানে কেউ না কেউ ঘটনাকে ঘটতে দিয়েছে।'

গোপালগঞ্জের ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতিকেই দায়ী করছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এই ঘটনা জাতির জন্য অশনি সংকেত বলেই মনে করেন তিনি। 'শুধু শেখ হাসিনা চলে গেলেই যে ফ্যাসিবাদ চলে গেছে, তা নয়। তার দল, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, যুবলীগ এখনো রয়ে গেছে,' যোগ করেন তিনি।

'একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো দলের সরকার নয়। জনগণ তো আশা করে তাদের কাছে জানমাল নিরাপদ থাকবে, ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে, দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতকারিদের কঠোর হস্তে দমন করবে। সেটা কিন্তু দেখা যায়নি,' বলেন গোলাম পরওয়ার।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

তাজউদ্দীনের জন্ম শতবার্ষিকীতে প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছে তাজউদ্দীন পরিবার। এ সময় পরিবারের পক্ষ থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

১৯ ঘণ্টা আগে

নির্বাচন ভণ্ডুল করার পাঁয়তারা চলছে: ওয়ার্কার্স পার্টি

২০ ঘণ্টা আগে

চেয়েছিলাম ডেমোক্রেসি, হয়ে যাচ্ছে মবক্রেসি: সালাহউদ্দিন

সরকারের উদ্দেশে তিনি সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, ‘নির্বাচন বিলম্বিত করতে যে ষড়যন্ত্র চলছে, তা যেন প্রশ্রয় না পায়। জনগণের মনে যাতে এ প্রশ্ন না জাগে যে সরকার কোনো একটি বিশেষ দলকে সুবিধা দিতে চাইছে।’

২১ ঘণ্টা আগে

ব্যাটল অব থার্মোপিলাই: সাহস ও আত্মত্যাগের অমর ইতিহাস

এই যুদ্ধের পটভূমি বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে তার আগের দশকগুলোতে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের আশপাশে পারস্য সাম্রাজ্য তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। বর্তমান ইরান, ইরাক, তুরস্ক, আফগানিস্তান, মিশরসহ এক বিশাল এলাকা জুড়ে পারস্যের শাসন বিস্তৃত ছিল।

১ দিন আগে