শান্তির নোবেল সামরিক অভিযান চালানো রাষ্ট্রপতিকে উৎসর্গ!

জান্নাতুল বাকেয়া কেকা

ভেনিজুয়েলায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে দেশটির বিরোধী নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা বিশ্ব জুড়ে বিস্তর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে মাদক কারবারের অভিযোগে অভিযুক্ত করা, তাকে ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার ঘোষণা— সব মিলিয়ে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক চাপ ও সামরিক হুমকির মধ্যেই এই নোবেল ঘোষণার ঘটনা ঘটেছে।

প্রশ্ন উঠছে— একই দেশে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক তৎপরতায় লিপ্ত, সেই দেশের বিরোধী নেত্রীকে শান্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা কি নিছক কাকতালীয়?

মাত্র কদিন আগেই ভেনিজুয়েলার উপকূলে অন্তত পাঁচটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান শনাক্তের কথা জানান দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ভ্লাদিমির পাদ্রিনো। তিনি একে প্রকাশ্য সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন হিসেবে উল্লেখ করেন। এ ঘটনার পর সাধারণ নাগরিকরাও আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন— যুদ্ধের হুমকি তখন একেবারে বাস্তব।

বিশ্লেষকদের মতে, ল্যাটিন আমেরিকার এই তেলসমৃদ্ধ দেশটি বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক সম্পদ লুণ্ঠনের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিও তারই সম্প্রসারিত রূপ, যেখানে রাজনৈতিক বিরোধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক হুমকি মিলেমিশে এক বহুমাত্রিক চাপে রূপ নিয়েছে।

এরই মধ্যে নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণায় উঠে আসে মারিয়া কোরিনা মাচাদোর নাম। নোবেল কমিটি বলেছে, ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দীর্ঘ সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ ভেনিজুয়েলার জনগণের পক্ষে শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের জন্য প্রচেষ্টা’— এটিই তাকে পুরস্কার দেওয়ার কারণ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন এক প্রশ্ন উসকে দেয়— বৈশ্বিক রাজনীতির কৌশলগত দাবায় ‘গণতন্ত্র’ ও ‘মানবাধিকার’ কি এখন শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে?

ইতিহাস সাক্ষী, সাম্রাজ্যবাদ ও তথাকথিত গণতন্ত্রের নাম করে যে দেশগুলোতে হস্তক্ষেপ হয়েছে, সেখানে রক্তপাত, অস্থিতিশীলতা ও মানবিক বিপর্যয়ই বেড়েছে। ভেনিজুয়েলাও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রেসিডেন্ট মাদুরোর বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের উত্থাপিত অভিযোগের কোনো প্রমাণ আজও প্রকাশিত হয়নি। তবু যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারিবীয় সাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন, মাদুরোকে ধরিয়ে দিলে ৫০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের ঘোষণা— সবই যেন সেই পুরোনো উপনিবেশিক কৌশলেরই নতুন রূপ।

মাদুরোর বক্তব্য স্পষ্ট— ‘সামরিক হুমকির মাধ্যমে তারা আমাদের সরকার পরিবর্তন করতে চায়। আটটি যুদ্ধজাহাজ, ১২০০ মিসাইল ও সাবমেরিন দিয়ে তারা আমাদের লক্ষ্য করছে।’ এই বক্তব্য কেবল কোনো রাষ্ট্রনেতার নয়, বরং এক সার্বভৌম জাতির আত্মরক্ষার আর্তি।

এমন পরিস্থিতিতে তার দেশের বিরোধী নেত্রীকে শান্তির দূত হিসেবে নোবেলে ভূষিত করা নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক রাজনীতির আরেক নতুন অধ্যায়। বিশ্ব যেন ক্রমেই প্রকাশ্য দ্বিমুখী বাস্তবতায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে সামরিক আগ্রাসন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ও রাজনৈতিক প্ররোচনার মাঝেই ‘শান্তি’র সংজ্ঞা নির্ধারিত হচ্ছে।

এভাবে নোবেল পুরস্কারের মতো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যদি সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির কৌশলগত সহযোগী হয়ে ওঠে, তবে সেটি কেবল মানবতার প্রতি অবিচার নয়, বরং শান্তির ভাবমূর্তিরই অবমাননা। আজ বৈশ্বিক শক্তিধররা ‘গণতন্ত্র রপ্তানি’র নামে যে নগ্ন রাজনৈতিক খেলা খেলছে, তাতে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মানবাধিকারের আসল মানেই ধূসর হয়ে যাচ্ছে।

বাণিজ্যিক লোভ থেকে শুরু করে সামরিক দাপট— সবই যেন এক মহাযজ্ঞের অংশ, যেখানে মানবজীবনের মূল্য ক্রমেই কমে আসছে। পৃথিবী আজ এমন এক সময়ে পৌঁছেছে, যেখানে সামান্য অস্থিরতাও ধ্বংসের দ্বার খুলে দিতে পারে।

তাই মনে হয়— বিশ্ব এখন এক মহা নাট্যমঞ্চে, যেখানে ‘শান্তি’ ও ‘গণতন্ত্র’ কেবল মুখোশ, আর পেছনে চলছে শক্তিধরদের নিষ্ঠুর কৌশলের মহড়া। মানবতার ভবিষ্যৎ আজ সেই নাটকের প্রান্তে দাঁড়িয়ে, যেখানে করতালির শব্দও ভয়ে কেঁপে ওঠে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

যুদ্ধবিরতি উপেক্ষা করে গাজায় ইসরায়েলি হামলা, নিহত ৯

মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। জানায়, নিহতদের গাজার আল-আহলি ও আল-নাসের হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করে।

৩ দিন আগে

আরও চার জিম্মির মরদেহ ইসরায়েলের কাছে হস্তান্তর করেছে হামাস

২৮ জন নিহত ইসরায়েলি জিম্মির মৃতদেহ ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত গাজায় ত্রাণ সরবরাহ সীমিত করার হুমকির পরই মরদেহ হস্তান্তর করে হামাস।

৩ দিন আগে

ইসরায়েলকে সহায়তার অভিযোগে ৩৩ জনকে হত্যা করল হামাস

গত মাসেও হামাস-নেতৃত্বাধীন কর্তৃপক্ষ ইসরাইলের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল।

৩ দিন আগে

তিনি সুন্দরী তরুণী— ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে বললেন ট্রাম্প

এ সময় মেলোনির দিকে ঘুরে তাকিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘আপনাকে কেউ সুন্দরী বললে নিশ্চয় কিছু মনে করবেন না, তাই না? কারণ আপনি সত্যিই সুন্দরী।’

৪ দিন আগে