বিবিসি বাংলা
ঈদুল আজহার ছুটির মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্যের বেশির ভাগ অংশ। জাতীয় কবির একটি গানকে ভিত্তি করে গত বছর নির্মাণ করা হয়েছিল ভাস্কর্যটি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে ব্যাপক সমালোচনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ ও পুরাতন কলা অনুষদ ভবনের মাঝে পুকুরের কিনারে সাবেক উপাচার্য সৌমিত্র শেখরের আমলে এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের নির্দেশে ভাস্কর্যটি প্রায় পুরো ভেঙে ফেলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাবি, শিক্ষার্থীদের দাবির ভিত্তিতেই ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে অনুমোদিত মূল নকশায় ফিরে যেতে এই ভাস্কর্য ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ডিন ও শিক্ষকরা বলছেন, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, ডিনস কমিটি বা প্রশাসনিক কোনো কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে ‘আনুষ্ঠানিক’ কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না।
উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, তিনি সংস্কৃতি লালনের পক্ষে ও ভাস্কর্য ভাঙার পক্ষে নন। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে যে দাবিগুলো করা হয়েছিল, তার মধ্যে ভাস্কর্য সংস্কারের দাবি ছিল। সেসময়ই ছাত্ররা ভাস্কর্যটির দুইটি আঙুল ভেঙেছিল। তবে আমি ভাঙার পক্ষে নই।
সৌন্দর্যবর্ধন ও সংস্কারের নামে ভাস্কর্য ভাঙার জন্য ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা’ কোনো লিখিত আবেদন নয়, বরং মৌখিকভাবে এ দাবি জানিয়েছিল বলে জানান উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম।
এখন ভাস্কর্যটির দুই হাতের অঞ্জলি পুরোপুরি ভেঙে ফেলার পর বুধবার (১৮ জুন) এক জুম মিটিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আপাতত ভাস্কর্যটি ভাঙার কাজ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর আগে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে সারা দেশে অন্তত হাজারখানেক ভাস্কর্য, ম্যুরাল, স্থাপনা ও মাজারে হামলা করে ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। এমনকি নারী ফুটবলারদের খেলা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে কেবল বিবৃতি দিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে দেখা গেছে। এসব ঘটনায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার সমালোচনাও করেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনটা যদি এরকম হয় যে এসব ভাঙচুর কিংবা এসব বিষয়ে যে জায়গাগুলোতে আমার মনে হয় অস্তিত্বের সংকট হয় সেসব জায়গায় কথা বলব আর যে জায়গায় স্বার্থ সিদ্ধি হয় সেসব জায়গায় চুপ থাকব— এ রকম পরিস্থিতি হলে তো এসব ঘটনা চলমানই থাকবে। এগুলো থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ এই ছবি পোস্ট করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ছবি: ফেসবুক
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভাস্কর্য ভাঙা ঠিক কবে শুরু হয়েছে, তা জানাতে পারেননি কেউ। বিদেশে অবস্থানরত উপাচার্যের দাবি, তিনি নিজেও জানেন না কবে ভাঙা শুরু হয়েছে।
নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ তার হাতের ছবি থেকে নির্মিত এই ভাস্কর্য ভাঙা প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে গত মঙ্গলবার (১৭ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এরপরই বিষয়টি আলোচনায় আসে।
ইংরেজিতে লেখা মুনমুন আহমেদের স্ট্যাটাসের বাংলা অর্থ এমন— কেউ কি তাদের থামাতে পারেন? নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ম্যুরাল। এটি ভাস্কর্যবিদ মনিন্দ্র পাল করেছিলেন। খুবই দুঃখজনক যে এই মুহূর্তে সেটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
শুধু এই শিল্পীই নন, ছুটির মধ্যে কাউকে না জানিয়ে এই ভাস্কর্য ভাঙার সমালোচনা করে ফেসবুকে সরব হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রায়হানা আক্তার ফেসবুকে ক্ষোভ জানিয়ে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ভাঙলেন যেহেতু, বিশ্ববিদ্যালয় খুললে আমাদের চোখের সামনেই গুঁড়িয়ে দিতেন... ছুটির মধ্যে লুকিয়ে ভাঙা তো দরকার ছিল না!
এই শিক্ষক আরও লিখেছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডিন ও অনেকের সিদ্ধান্তে এ কাজ করা হয়েছে বলে তাদের জানানো হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে জানতেন না উল্লেখ করে রায়হানা আক্তার লিখেছেন, এর নান্দনিকতা নিয়ে আপত্তি থাকলে সংস্কার করতে আমাদের চারুকলার শিক্ষকরাই তো যথেষ্ট ছিলেন। আমার-আপনার ট্যাক্সের টাকা দিয়েই তো ভাঙা-গড়ার এই মহোৎসব চলছে। পকেট কাদের ভরছে, নতুন করে আর না-ই বা বললাম!
জুলাই আন্দোলনের পর অনেক ভাস্কর্য-স্থাপনা ভাঙার দিকে ইঙ্গিত করে এই শিক্ষক আরও লিখেছেন, ভাঙলেন তো অনেক... আরেক জুলাই সমাগত... কী কী গড়লেন, এবার তারও একটা ফিরিস্তি হোক!
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধনও করেছেন মঙ্গলবার। ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন নজরুলের সৃষ্টির অবমাননা’, ‘সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে’, ‘ভাঙনের সিদ্ধান্ত দাতাদের থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করো’— এমন সব স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে শিক্ষার্থীরা ভেঙে ফেলা ওই ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করেন।
ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী জিহাদুজ্জামান জিসান বলেন, ১৭ তারিখে (১৭ জুন) সম্ভবত ভাঙার কাজ শুরু হয়। গত তিন-চার মাসেও এই ভাস্কর্য নিয়ে আন্দোলন বা কোনো কিছুই হয়নি। নতুন প্রশাসন যখনই আসে তখনই এখানে ভাঙচুরের খেলা চলে। এখানে ভিসিদের ইগো কাজ করে।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভাস্কর্যটি মূল নকশা অনুযায়ী করা হয়নি বলে দাবি করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ছবি:
সাবেক উপাচার্য মোহিতুল আলম এই পুকুরের ওপর একটি ‘সিন্ধু সারস’ অর্থাৎ ভাসমান একটি ঘর বানিয়েছিলেন, যা পরবর্তী উপাচার্য মুস্তাফিজুর রহমান ব্যবহার করেননি। পরে উপাচার্য সৌমিত্র শেখর ওই ‘সিন্ধু সারস’ ভেঙে ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্যটি স্থাপন করেন বলে জানান জিহাদুজ্জামান জিসান।
ক্ষোভ জানিয়ে এ শিক্ষার্থী বলেন, এক প্রশাসনের কাজ আরেক প্রশাসনের চোখের বিষ— এ রকম একটি বিষয়। এখনকার প্রশাসন এটা ভেঙে আরেকটা তৈরি করবে। জনগণের টাকায় এক ধরনের ভাঙাগড়ার খেলা চলছে।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ইমদাদুল হুদা বিবিসি বাংলার কাছে স্বীকার করেন, ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কেউ কিছু জানতেন না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি।
ইমদাদুল হুদা বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনার পর ছাত্রদের নানা ধরনের দাবি ছিল। তার মধ্যে একটি দাবি ছিল যে এই ভাস্কর্যটি এখানে বেমানান। সৌন্দর্য বাড়ানোর বদলে বরং সৌন্দর্যহানি করেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ফরমাল কোনো আলোচনা বা কোনো ফরমাল মিটিংও করেনি।
এরই মধ্যে মঙ্গলবার ভাস্কর্যটি ভাঙার খবর ছড়িয়ে পড়লে উপাচার্য, সব ডিন ও প্রশাসনের সবার সমন্বয়ে জুমে অনলাইনে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে পুরোপুরি ভেঙে না ফেলে যতটুকু ভাঙা হয়েছে ততটুকু পর্যন্তই কাজ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে আগামী ২২ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস খুলবে, ক্লাস শুরু হবে ২৯ জুন। ২২ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে, যেখানে এ বিষয়ে সবকিছু পর্যালোচনা করা হবে।
বর্তমানে ছুটিতে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, আগের ভাস্কর্যটি অনুমোদিত নকশার রূপে ছিল না। তাই ওই রূপে ফিরিয়ে নিতে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যই এ আয়োজন।
‘অঞ্জলি লহো মোর’ ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে অনলাইন-অফলাইনে। ছবি: সংগৃহীত
গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলায় ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্থাপনা ভাঙা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, বিভিন্ন স্থানে তার ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংবলিত শিল্পী শামীম সিকদারের ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ এবং ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী শশীলজে থাকা ভেনাসের ভাস্কর্য ভাঙার খবর নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তবে এসব ঘটনায় সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে পদক্ষেপ খুবই কম দেখা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান আশঙ্কা জানিয়ে বলেন, সরকারের এরকম উদাসীনতায় এসব ঘটনা বাড়বে বৈ কমবে না। দলমত সবকিছু নির্বিশেষে শুধু দেশের স্বার্থ যদি ভাবা হয়, তাহলে হয়তো একটা পরিবর্তন আসবে। অথবা যারা এগুলো করছে তারা ভয় পাবে।
এ ধরনের বিষয়ে সরকারের আরও কঠোরভাবে হস্তক্ষেপ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসা সবসময় থাকলেও অজ্ঞতা ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই এ ধরনের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর হামলা করা হয়।
রাশেদা রওনক খান বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনেক সময় আগেরজনের কাজ পরেরজন ভেঙে ফেলবে— এমন বিষয়ও কাজ করে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত হিংসা-প্রতিহিংসাও কাজ করেছে।
ঈদুল আজহার ছুটির মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্যের বেশির ভাগ অংশ। জাতীয় কবির একটি গানকে ভিত্তি করে গত বছর নির্মাণ করা হয়েছিল ভাস্কর্যটি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে ব্যাপক সমালোচনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ ও পুরাতন কলা অনুষদ ভবনের মাঝে পুকুরের কিনারে সাবেক উপাচার্য সৌমিত্র শেখরের আমলে এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের নির্দেশে ভাস্কর্যটি প্রায় পুরো ভেঙে ফেলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাবি, শিক্ষার্থীদের দাবির ভিত্তিতেই ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে অনুমোদিত মূল নকশায় ফিরে যেতে এই ভাস্কর্য ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ডিন ও শিক্ষকরা বলছেন, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, ডিনস কমিটি বা প্রশাসনিক কোনো কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে ‘আনুষ্ঠানিক’ কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না।
উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, তিনি সংস্কৃতি লালনের পক্ষে ও ভাস্কর্য ভাঙার পক্ষে নন। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে যে দাবিগুলো করা হয়েছিল, তার মধ্যে ভাস্কর্য সংস্কারের দাবি ছিল। সেসময়ই ছাত্ররা ভাস্কর্যটির দুইটি আঙুল ভেঙেছিল। তবে আমি ভাঙার পক্ষে নই।
সৌন্দর্যবর্ধন ও সংস্কারের নামে ভাস্কর্য ভাঙার জন্য ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা’ কোনো লিখিত আবেদন নয়, বরং মৌখিকভাবে এ দাবি জানিয়েছিল বলে জানান উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম।
এখন ভাস্কর্যটির দুই হাতের অঞ্জলি পুরোপুরি ভেঙে ফেলার পর বুধবার (১৮ জুন) এক জুম মিটিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আপাতত ভাস্কর্যটি ভাঙার কাজ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর আগে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে সারা দেশে অন্তত হাজারখানেক ভাস্কর্য, ম্যুরাল, স্থাপনা ও মাজারে হামলা করে ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। এমনকি নারী ফুটবলারদের খেলা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে কেবল বিবৃতি দিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে দেখা গেছে। এসব ঘটনায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার সমালোচনাও করেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনটা যদি এরকম হয় যে এসব ভাঙচুর কিংবা এসব বিষয়ে যে জায়গাগুলোতে আমার মনে হয় অস্তিত্বের সংকট হয় সেসব জায়গায় কথা বলব আর যে জায়গায় স্বার্থ সিদ্ধি হয় সেসব জায়গায় চুপ থাকব— এ রকম পরিস্থিতি হলে তো এসব ঘটনা চলমানই থাকবে। এগুলো থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ এই ছবি পোস্ট করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ছবি: ফেসবুক
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভাস্কর্য ভাঙা ঠিক কবে শুরু হয়েছে, তা জানাতে পারেননি কেউ। বিদেশে অবস্থানরত উপাচার্যের দাবি, তিনি নিজেও জানেন না কবে ভাঙা শুরু হয়েছে।
নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ তার হাতের ছবি থেকে নির্মিত এই ভাস্কর্য ভাঙা প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে গত মঙ্গলবার (১৭ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এরপরই বিষয়টি আলোচনায় আসে।
ইংরেজিতে লেখা মুনমুন আহমেদের স্ট্যাটাসের বাংলা অর্থ এমন— কেউ কি তাদের থামাতে পারেন? নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ম্যুরাল। এটি ভাস্কর্যবিদ মনিন্দ্র পাল করেছিলেন। খুবই দুঃখজনক যে এই মুহূর্তে সেটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
শুধু এই শিল্পীই নন, ছুটির মধ্যে কাউকে না জানিয়ে এই ভাস্কর্য ভাঙার সমালোচনা করে ফেসবুকে সরব হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রায়হানা আক্তার ফেসবুকে ক্ষোভ জানিয়ে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ভাঙলেন যেহেতু, বিশ্ববিদ্যালয় খুললে আমাদের চোখের সামনেই গুঁড়িয়ে দিতেন... ছুটির মধ্যে লুকিয়ে ভাঙা তো দরকার ছিল না!
এই শিক্ষক আরও লিখেছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডিন ও অনেকের সিদ্ধান্তে এ কাজ করা হয়েছে বলে তাদের জানানো হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে জানতেন না উল্লেখ করে রায়হানা আক্তার লিখেছেন, এর নান্দনিকতা নিয়ে আপত্তি থাকলে সংস্কার করতে আমাদের চারুকলার শিক্ষকরাই তো যথেষ্ট ছিলেন। আমার-আপনার ট্যাক্সের টাকা দিয়েই তো ভাঙা-গড়ার এই মহোৎসব চলছে। পকেট কাদের ভরছে, নতুন করে আর না-ই বা বললাম!
জুলাই আন্দোলনের পর অনেক ভাস্কর্য-স্থাপনা ভাঙার দিকে ইঙ্গিত করে এই শিক্ষক আরও লিখেছেন, ভাঙলেন তো অনেক... আরেক জুলাই সমাগত... কী কী গড়লেন, এবার তারও একটা ফিরিস্তি হোক!
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধনও করেছেন মঙ্গলবার। ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন নজরুলের সৃষ্টির অবমাননা’, ‘সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে’, ‘ভাঙনের সিদ্ধান্ত দাতাদের থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করো’— এমন সব স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে শিক্ষার্থীরা ভেঙে ফেলা ওই ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করেন।
ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী জিহাদুজ্জামান জিসান বলেন, ১৭ তারিখে (১৭ জুন) সম্ভবত ভাঙার কাজ শুরু হয়। গত তিন-চার মাসেও এই ভাস্কর্য নিয়ে আন্দোলন বা কোনো কিছুই হয়নি। নতুন প্রশাসন যখনই আসে তখনই এখানে ভাঙচুরের খেলা চলে। এখানে ভিসিদের ইগো কাজ করে।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভাস্কর্যটি মূল নকশা অনুযায়ী করা হয়নি বলে দাবি করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ছবি:
সাবেক উপাচার্য মোহিতুল আলম এই পুকুরের ওপর একটি ‘সিন্ধু সারস’ অর্থাৎ ভাসমান একটি ঘর বানিয়েছিলেন, যা পরবর্তী উপাচার্য মুস্তাফিজুর রহমান ব্যবহার করেননি। পরে উপাচার্য সৌমিত্র শেখর ওই ‘সিন্ধু সারস’ ভেঙে ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্যটি স্থাপন করেন বলে জানান জিহাদুজ্জামান জিসান।
ক্ষোভ জানিয়ে এ শিক্ষার্থী বলেন, এক প্রশাসনের কাজ আরেক প্রশাসনের চোখের বিষ— এ রকম একটি বিষয়। এখনকার প্রশাসন এটা ভেঙে আরেকটা তৈরি করবে। জনগণের টাকায় এক ধরনের ভাঙাগড়ার খেলা চলছে।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ইমদাদুল হুদা বিবিসি বাংলার কাছে স্বীকার করেন, ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কেউ কিছু জানতেন না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি।
ইমদাদুল হুদা বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনার পর ছাত্রদের নানা ধরনের দাবি ছিল। তার মধ্যে একটি দাবি ছিল যে এই ভাস্কর্যটি এখানে বেমানান। সৌন্দর্য বাড়ানোর বদলে বরং সৌন্দর্যহানি করেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ফরমাল কোনো আলোচনা বা কোনো ফরমাল মিটিংও করেনি।
এরই মধ্যে মঙ্গলবার ভাস্কর্যটি ভাঙার খবর ছড়িয়ে পড়লে উপাচার্য, সব ডিন ও প্রশাসনের সবার সমন্বয়ে জুমে অনলাইনে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে পুরোপুরি ভেঙে না ফেলে যতটুকু ভাঙা হয়েছে ততটুকু পর্যন্তই কাজ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে আগামী ২২ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস খুলবে, ক্লাস শুরু হবে ২৯ জুন। ২২ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে, যেখানে এ বিষয়ে সবকিছু পর্যালোচনা করা হবে।
বর্তমানে ছুটিতে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, আগের ভাস্কর্যটি অনুমোদিত নকশার রূপে ছিল না। তাই ওই রূপে ফিরিয়ে নিতে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যই এ আয়োজন।
‘অঞ্জলি লহো মোর’ ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে অনলাইন-অফলাইনে। ছবি: সংগৃহীত
গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলায় ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্থাপনা ভাঙা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, বিভিন্ন স্থানে তার ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংবলিত শিল্পী শামীম সিকদারের ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ এবং ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী শশীলজে থাকা ভেনাসের ভাস্কর্য ভাঙার খবর নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তবে এসব ঘটনায় সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে পদক্ষেপ খুবই কম দেখা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান আশঙ্কা জানিয়ে বলেন, সরকারের এরকম উদাসীনতায় এসব ঘটনা বাড়বে বৈ কমবে না। দলমত সবকিছু নির্বিশেষে শুধু দেশের স্বার্থ যদি ভাবা হয়, তাহলে হয়তো একটা পরিবর্তন আসবে। অথবা যারা এগুলো করছে তারা ভয় পাবে।
এ ধরনের বিষয়ে সরকারের আরও কঠোরভাবে হস্তক্ষেপ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসা সবসময় থাকলেও অজ্ঞতা ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই এ ধরনের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর হামলা করা হয়।
রাশেদা রওনক খান বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনেক সময় আগেরজনের কাজ পরেরজন ভেঙে ফেলবে— এমন বিষয়ও কাজ করে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত হিংসা-প্রতিহিংসাও কাজ করেছে।
সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায়ও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ২৪৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১০৪ জনই বরিশাল বিভাগের সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকার রোগী। তবে এসময়ে ডেঙ্গুতে কোনো রোগী মারা যায়নি।
১০ ঘণ্টা আগেআসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী প্রচারে পোস্টার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আজ বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত করার পর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফ
১২ ঘণ্টা আগেনির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী এখনো অফিশিয়ালি কোনো নির্দেশনা পায়নি। তবে নির্দেশনা পেলে দায়িত্ব পালনে বাহিনীর সদস্যরা প্রস্তুত বলে জানিয়েছে সেনাসদর
১২ ঘণ্টা আগেধর্ষণ মামলায় আটক আলোচিত-সমালোচিত গায়ক মাইনুল আহসান নোবেলের সঙ্গে মামলার বাদীর (ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী) রেজিস্ট্রি কাবিননামার মাধ্যমে বিবাহ সম্পাদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত।
১৩ ঘণ্টা আগে