স্ত্রীর কিডনিতে নতুন জীবন পেয়েই পরকীয়ায় জড়ালেন স্বামী!

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৪: ১৯

স্বামীর দুটি কিডনি প্রায় অচল ছিল। পরে নিজের কিডনি দিয়ে স্বামীকে প্রাণে বাঁচান স্ত্রী। কিন্তু সেই স্বামী সুস্থ হয়ে জড়িয়ে পড়েন পরকীয়ায়। এর পর সেই স্ত্রীকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন মোহাম্মদ তারেক।

ঘটনাটি ঘটেছে সাভারের কলমি এলাকায়। এ ঘটনায় স্বামী মোহাম্মদ তারেকের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করেছেন স্ত্রী উম্মে সাহেদীনা টুনি। পরে তারেককে গ্রেপ্তার করা হলেও বর্তমানে জামিনে আছেন।

জানা গেছে, ২০০৬ সালে পারিবারিকভাবে কলেজপড়ুয়া তরুণী উম্মে সাহেদীনা টুনির সঙ্গে মালয়েশিয়া প্রবাসী তারেকের বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পরই তারেক ও টুনির সংসার আলো করে আসে ছেলে সন্তান। নাম রাখা হয় আজমাইন দিব্য। সব ঠিকঠাক চলছিল। তবে ২০০৮ সালের মাঝামাঝি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তারেক। চিকিৎসকরা জানান, তার দুটি কিডনিই প্রায় অচল হয়ে গেছে। রোগীকে বাঁচাতে হলে অতি দ্রুত ডায়ালাইসিস শুরু করাতে হবে। তবে এ পরিস্থিতিতেও টুনি স্বামীর হাত শক্ত করে ধরেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা মতো ভারতের সিএমসি হাসপাতালে শুরু হয় তারেকের চিকিৎসা।

কয়েক বছর পর চিকিৎসকরা জানান, রোগীকে বাঁচাতে হলে দ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। তখন স্ত্রী টুনিই এগিয়ে আসেন। নিজের একটি কিডনি দিয়ে দেন স্বামীকে বাঁচাতে।

টুনি ভেবেছিলেন, এবার হয়তো তার কষ্টের জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু বিষয়টিকে ভুল প্রমাণ করেছে তারেকের কর্মকাণ্ড। সুস্থ হয়েই তারেক জড়িয়ে পড়েন পরকীয়ায়। ডিভোর্সি এক নারীর প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েন। পাশাপাশি অনলাইন জুয়ার নেশাও পেয়ে বসে তাকে। একপর্যায়ে মারধর করে স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে পরকীয়া প্রেমিকার সঙ্গে গিয়ে ওঠেন অন্য বাড়িতে।

তারেকের চিকিৎসার খরচ যোগাতে টুনি নিজের বাড়িতেই খোলেন হোম বিউটি পার্লার। পাশাপাশি বুটিকসের কাজ শুরু করেন। মাস শেষে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা উপার্জন করতেন। আর পুরো টাকা ব্যয় করতেন তারেকের চিকিৎসায়।

এভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। নিজের জমানো টাকা, বিয়ের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসা চালিয়ে যান তিনি। চিকিৎসকদের পরামর্শে টুনিকে বছরে তিন বার তারেককে নিয়ে ভারতে যেতে হতো। প্রতিবার প্রায় দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হতো। যা পুরোটাই আসতো নিজের আয় ও স্বর্ণালংকার বিক্রির টাকা থেকে।

অপরদিকে, অসুস্থ তারেক কোনো কাজকর্ম করতে পারতেন না। সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়ায় একটা সময় পরিবারও তার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেবল স্ত্রী টুনি ও একমাত্র সন্তানই তার পাশে ছিল। একপর্যায়ে খরচ সামলাতে না পেরে নিজের মায়ের পেনশনের টাকাও স্বামীর চিকিৎসায় ব্যয় করেন টুনি। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের বেশি সময় ভারতেই চলে তারেকের চিকিৎসা। ২০১৯ সালের শুরুতে চিকিৎসকরা জানান, এবার তারেককে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। নয়তো ডায়ালাইসিস করেই বাকিটা জীবন বাঁচতে হবে।

পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে টেস্টে মিললেও কেউ কিডনি দিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে স্ত্রী টুনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজের কিডনি দিয়ে হলেও স্বামীর প্রাণ বাঁচাবেন।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসক কৈলাস নাথ সিং (কেএন সিং)-এর তত্ত্বাবধানে টুনি ও তারেকের কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে টুনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তারেককে কিডনি দেওয়ার পর আমার শারীরিক অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে চলে যায়। সাত দিন আইসিইউতে রাখা হয়। আইসিইউ থেকে কেবিনে নিয়ে আসার পরই যেন অন্য এক তারেককে আবিষ্কার করলাম। যেই মানুষটার জন্য আমার সবকিছু ত্যাগ করেছি, নিজের জীবন দিয়ে হলেও তাকে বাঁচাতে চেয়েছি; সেই কিনা কিডনি পেয়ে সুস্থ হয়েই হাসপাতালে আমার সঙ্গে চিৎকার করতে শুরু করল, মারতে উদ্যত হলো। আমার এক খালা কেন অপারেশনের আগে টাকা পাঠাতে দেরি করেছিল- এমনটা বলে চিল্লাচিল্লি করল।’

টুনির আরও বলেন, ‘‘সেদিন তারেকের এমন কর্মকাণ্ড দেখে হাসপাতালের চিকিৎসকরাও অবাক হন। এর পর আমাদের দুজনকে সেই চিকিৎসক তার চেম্বারে ডেকে নেন, যিনি অপারেশনটা করেছিলেন। সেখানে তারেককে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘যদি তোমার মা হয় তোমার জন্মদাতা, এই নারী তোমার জীবনদাতা। এর কারণে তুমি পুনরায় জীবন পেয়েছ, সুস্থতা ফিরে পেয়েছ। তার সঙ্গে কীভাবে এমন দুর্ব্যবহার করতে পারলে।’ এরপর চুপ হয়ে যান তারেক। পরে আমরা দেশে ফিরে আসি।’’

টুনি জানান, তবে ঢাকায় ফেরার পরই জীবনে নেমে আসে নরক। সুস্থ হয়ে তারেক নতুন কোনো চাকরি কিংবা ব্যবসা শুরু তো দূরের কথা উল্টো তাকে চাপ দেন উপার্জনের সব টাকা তার হাতে তুলে দিতে এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে আরও টাকা নিয়ে আসতে। একপর্যায়ে অনলাইন জুয়া ও পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে তারেক। যেই স্ত্রীর জন্য নিজের জীবন ফিরে পেলেন, তার গায়ে হাত তুলতে শুরু করেন।

টুনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় কাজের অজুহাতে ঢাকায় গিয়ে সময় কাটাত তারেক। এক সময় জানতে পারি, তাহমিনা নামে এক ডিভোর্সী নারীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরকীয়ায় লিপ্ত সে। তারেকের মোবাইল ঘেঁটে এসবের প্রমাণও পাই। বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, সে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। একপর্যায়ে আমাকে পুরো বাড়ি তার নামে লিখে দিয়ে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য চাপ দেয়।’

নির্যাতন সইতে না পেরে গত ২ ফেব্রুয়ারি সাভার থানায় গিয়ে তারেকের নামে অভিযোগ করেন টুনি। কিন্তু এর পরই আবারও নিজের খোলস পাল্টে ফেলেন তারেক। টুনিকে বুঝিয়ে এক দিন পরেই (৪ ফেব্রুয়ারি) থানায় মুচলেকা দিয়ে সেই অভিযোগ তুলে ফেলেন তিনি।

স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পর নির্যাতনের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে পালিয়ে নিজের বাবার বাড়িতে ওঠেন টুনি। এর পর ২২ এপ্রিল তারেকের বিরুদ্ধে ঢাকার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যৌতুক ও নারী নির্যাতনের মামলা করেন টুনি। সেই মামলায় ২৪ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন তারেক। এক মাস কারাগারে থাকার পর গত ৪ জুন জামিনে মুক্ত হন তিনি। জামিনে মুক্ত হয়েই পরকীয়া প্রেমিকার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন তারেক। সেখান থেকেই স্ত্রীকে চাপ দেন ডিভোর্স দিয়ে বাড়িটা তার নামে লিখে দেওয়ার জন্য।

এ প্রসঙ্গে টুনি বলেন, ‘আমার স্বামীকে আমি সবসময় ফেরেশতার মতো মনে করতাম। ভাবতাম, তিনি কখনোই মিথ্যা বলেন না। তবে আমার পরিবারের মানুষ ধাপে ধাপে সতর্ক করেছিল। কারও কথা কানে নিইনি। বরং তারেকের কথায় অনেক সময় পরিবারের মানুষদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেছি। অথচ সেই মানুষটা আজ আমার সব কেড়ে নিল। তাকে কিডনি দেওয়ার পরে আমার শারীরিক অবস্থাও দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। চিকিৎসকেরাও নানাভাবে সতর্ক করেছেন।’

‘আমি জানি, সুস্থভাবে হয়তো বেশি দিন আর বাঁচতে পারব না। তবুও যেই মানুষটার কষ্ট কখনো নিজের চোখে দেখতে পারতাম না। যার জন্য সবকিছু ত্যাগ করেছি, সেই কিনা আমাকে এভাবে ঠকাল! আমার পেটে অপারেশনের জায়গাতে লাথি মারল...! আমি চাই না, আমার মতো পরিণতি আর কোনো মেয়ের হোক। আর কোনো মেয়ে যেন ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে নিজের জীবনকে এমন অন্ধকারে না ঠেলে দেয়।’

তারেক-টুনির এক প্রতিবেশী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিয়ের পর থেকেই দেখেছি টুনি আপা তার স্বামীর জন্য সবকিছু ত্যাগ করেছেন। তার যখন বিয়ে হয়, তখন বয়স ছিল ১৬-১৭ বছর। দুই বছরের মাথায় জানতে পারেন স্বামীর দুটি কিডনি অচল। তবুও স্বামীকে ফেলে যাননি। নিজের বাড়িতেই বিউটি পার্লার দিয়েছেন, বুটিকসের কাজ করেছেন। যা আয় করেছেন, তা দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা চালিয়েছেন। পরে যখন চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে, তখন নিজের কিডনি দিয়ে তারেকের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। অথচ, সুস্থ হওয়ার পর প্রায়ই দেখতাম, টুনি আপাকে নির্যাতন করত। পরে জানতে পারলাম তিনি পরকীয়া ও অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। টুনি আপাকে মারধর করত টাকা ও বাড়িটা লিখে দেওয়ার জন্য।’

টুনির মা বলেন, ‘পারিবারিকভাবে আমাদের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল ছিল। তারেকের চিকিৎসায় প্রতি বছর গড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ হতো। সেই টাকা টুনি কখনো আমাদের থেকেও নিয়ে যেত। আমার পেনশনের পুরো অর্থ তারেকের চিকিৎসায় খরচ করেছি। একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে টুনিদের থাকার জন্য বিল্ডিং তুলে দিয়েছিলাম। সেই বাড়ির অর্ধেক মেয়ের নামে আর বাকি অর্ধেক তারেকের নামে। অথচ আজ সেই বাড়ি নিজের নামে লিখে দেওয়ার জন্য আমার মেয়েকে নির্যাতন করছে, পরকীয়া প্রেমিকার সঙ্গে থাকছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তারেকের প্রতারণার কঠিন শাস্তি চাই। যেন আমার মেয়ের মতো কোনো মেয়ের জীবন এভাবে ধ্বংস না হয়।’

এদিকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই খোঁজ নেই তারেকের। পরিবর্তন করে ফেলেছেন নিজের ফোন নম্বরও। অন্যদিকে, তারেকের পরিবারের কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

চাঁনখারপুলে হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠনের আদেশ ১৪ জুলাই

গণঅভ্যুত্থানে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ৬ জনকে হত্যার ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়।

৭ ঘণ্টা আগে

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন পর্তুগিজ ফুটবলার দিয়োগো

মার্কার সংবাদ অনুযায়ী জোতা এবং তার ভাই আন্দ্রে স্পেনের জামোরা প্রদেশে দুর্ঘটনার শিকার হন। তাদের গাড়িটি রাস্তা থেকে ছিটকে পরলে আগুন ধরে যায়। এতে ভাইসহ জোতা মারা যান। জোতার ভাইও একজন পেশাদার ফুটবলার।

৭ ঘণ্টা আগে

পবিত্র আশুরা ঘিরে কোন শঙ্কা নেই: ডিএমপি

পবিত্র আশুরা ঘিরে নিরাপত্তার শঙ্কা নেই, বরং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। আজ সকালে রাজধানীর লালবাগে হোসেনি দালান পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) এস এন মো. নজ

৭ ঘণ্টা আগে

৫৩ বছরে রাষ্ট্র গঠনে এমন সুযোগ আসেনি: আলী রীয়াজ

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, ৫৩ বছরে রাষ্ট্র গঠনের এমন সুযোগ আর আসেনি। অনেক অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে এ সুযোগটা আমরা পেয়েছি, এ সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না।

৮ ঘণ্টা আগে