
প্রতিবেদক, রাজনীতি ডটকম

১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর তারিখটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কেবল একটি দিন নয়, বরং এটি ছিল সমরকৌশলের এক চূড়ান্ত পরিবর্তনের দিন, যেখানে আবেগের চেয়ে সামরিক পরিসংখ্যান এবং কৌশলগত অবস্থানই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। এ দিনই মুক্তিবাহিনী ‘হিট অ্যান্ড রান’ বা অতর্কিত হামলার কৌশল থেকে সরে ‘কনভেনশনাল ওয়ার’ বা সম্মুখ সমরের দিকে মোড় নেয়।
ডিসেম্বরের প্রথম এই দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তরে যে প্রতিবেদন জমা পড়েছিল তাতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, কেবল সীমান্তবর্তী এলাকাই নয়, দেশের অভ্যন্তরেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ১ ডিসেম্বর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দেশের চারটি ভিন্ন ভিন্ন রণাঙ্গনে বড় ধরনের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ডিফেন্সিভ পজিশন বা রক্ষণাত্মক ঘাঁটি হারাতে বাধ্য হয়। এ দিনে মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত ব্রিগেডগুলো, বিশেষ করে জেড ফোর্স ও এস ফোর্সের অধীন ব্যাটেলিয়নগুলো তাদের পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নামে।
সিলেট অঞ্চলের কানাইঘাট রণাঙ্গন ছিল ১ ডিসেম্বরের অন্যতম প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র। সেক্টর-৪-এর কমান্ডার মেজর সি আর দত্তের নেতৃত্বে এবং সেক্টর ট্রুপসের সহায়তায় এ অপারেশন পরিচালিত হয়। তবে এ যুদ্ধের মূল নায়ক ছিল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
সামরিক রেকর্ড অনুযায়ী, কানাইঘাট বাজার ও এর আশপাশের এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়েছিল। ১ ডিসেম্বর ভোর ৫টায় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রেভো কোম্পানি যৌথভাবে এ ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়।
এই যুদ্ধের রণকৌশল বিশ্লেষণে দেখা যায়, আক্রমণটি ছিল একটি ক্লাসিক ‘ডাবল এনভেলপমেন্ট’ বা দ্বিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণ। ম্যাপ অনুযায়ী, কানাইঘাট সদরের অবস্থান ছিল সুরমা নদীর তীরে। কৌশলগতভাবে পাকিস্তান বাহিনী কানাইঘাট হাইস্কুল ও ডাকবাংলোতে তাদের মেইন ডিফেন্সিভ পজিশন বা মূল প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করেছিল।
১ ডিসেম্বর আক্রমণের নকশা অনুযায়ী, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘আলফা কোম্পানি’ উত্তর-পূর্ব দিক থেকে সরাসরি বা ‘ফ্রন্টাল অ্যাটাক’ চালায়, যা ছিল মূলত শত্রুকে ব্যস্ত রাখার কৌশল বা ‘ডিকয়’। ঠিক একই সময়ে ‘ব্রাভো কোম্পানি’ অত্যন্ত গোপনে দীর্ঘ পথ ঘুরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর পালানোর পথ বন্ধ করে দেয়। সুরমা নদীর পাড় ধরে এই ‘ব্লকিং পজিশন’ নেওয়ার ফলেই পাকিস্তান বাহিনী কার্যত ফাঁদে পড়ে যায়।

সামনে থেকে আলফা কোম্পানির গুলিবর্ষণ আর পেছন থেকে ব্রাভো কোম্পানির অ্যামবুশ— এই দুইয়ের মাঝে পড়েই পাকিস্তান বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। প্রায় চার ঘণ্টা স্থায়ী এই তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ জন সেনা নিহত হন এবং ১৮ জন গুরুতর আহত অবস্থায় পালিয়ে যান। মুক্তিবাহিনীর ১১ জন বীর যোদ্ধা শহিদ হন।
এ যুদ্ধের বড় গুরুত্ব হলো, এটিই ছিল সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম বড় ধরনের কৌশলগত পরাজয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে ১ ডিসেম্বরের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, এ দিন থেকেই তাদের কাছে খবর আসছিল যে সীমান্ত পোস্টগুলো একে একে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
একই সময়ে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী সেক্টরেও (সেক্টর-১ ও ২) ১ ডিসেম্বর ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। বিশেষ করে ফেনীর বিলোনিয়া পকেট বা ‘বিলোনিয়া বালজ’ যুদ্ধটি সামরিক ইতিহাসে ‘ব্যাটল অব বিলোনিয়া’ নামে পরিচিত, যার চূড়ান্ত পর্যায় এ দিন দৃশ্যমান হয়।
দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাব-সেক্টর কমান্ডারদের নিপুণ পরিকল্পনায় এই এলাকায় অবস্থানরত পাকিস্তান বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়। সামরিক পরিভাষায় একে বলা হয় ‘এনসার্কলমেন্ট’। ১ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিলোনিয়া থেকে পিছু হটে ফেনী শহরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের পালানোর পথগুলো আগেই মাইন দিয়ে আটকে রেখেছিল মুক্তিবাহিনী।
এ দিনে বিলোনিয়া ও পরশুরাম এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ৫০ জন সৈন্য নিহত হন এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়, যার মধ্যে ছিল দুটি ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং প্রচুর চাইনিজ রাইফেল।
মেজর রফিকুল ইসলামের বই থেকে জানা যায়, ১ ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যেই ফেনীর উত্তরাংশ কার্যত মুক্ত হয়ে যায় এবং পাকিস্তান বাহিনী ফেনী শহরের হাইওয়েতে ডিফেন্সিভ পজিশন নিতে বাধ্য হয়। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই মুহূর্ত, যখন পাকিস্তানিরা বুঝতে পারে যে তাদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলো আর নিরাপদ নয়।
পশ্চিমাঞ্চলীয় রণাঙ্গন, বিশেষ করে দর্শনা ও চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে ১ ডিসেম্বরের যুদ্ধ ছিল মূলত আর্টিলারি ও হেভি মেশিনগানের লড়াই। ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকা এই অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭ নম্বর ব্রিগেডের সৈন্যরা বাংকার তৈরি করে অবস্থান নিয়েছিল।

১ ডিসেম্বর সকাল থেকে ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এবং মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি ইউনিট যৌথভাবে পাকিস্তান পজিশনের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। রেকর্ড অনুযায়ী, এ দিন দর্শনা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চারটি বাংকার সরাসরি কামানের গোলায় ধ্বংস হয়। এ আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯ জন সৈন্য ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
এ যুদ্ধের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো— এ আক্রমণের ফলে যশোর ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে দর্শনা সীমান্তের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়্যারলেস মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে জানা যায়, তারা তাদের সদর দপ্তরের কাছে জরুরি বিমান সহায়তা বা ‘এয়ার সাপোর্ট’ চেয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান বিমান বাহিনীর (PAF) সাবের জেটগুলো সেদিন আর উড্ডয়ন করতে পারেনি। কারণ ঢাকা ও কুর্মিটোলার রানওয়েগুলোর ওপর নজরদারি বাড়াতে শুরু করেছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী।
রাজধানী ঢাকায় ১ ডিসেম্বর ছিল ‘আরবান গেরিলা ওয়ারফেয়ার’ বা নগর গেরিলা যুদ্ধের এক নতুন অধ্যায়। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত তিনটি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনে একযোগে অপারেশন চালায় ক্র্যাক প্লাটুন ও বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যরা।
এসব আক্রমণের মধ্যে রামপুরা ও উলন পাওয়ার হাউজের অপারেশন ছিল সবচেয়ে নিখুঁত। ১ ডিসেম্বর রাত ৮টা ৩০ মিনিটে এ অপারেশন চালানো হয়। অপারেশনে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করে ট্রান্সফরমারগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে ঢাকার প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
এ অপারেশনের কৌশলগত দিকটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুৎ না থাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নাইট ভিশন ইকুইপমেন্ট ও সার্চলাইটগুলো অকেজো হয়ে পড়ে, যা তাদের রাতের টহল ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।
এ ছাড়া ১ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় মতিঝিল এলাকায় পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের সামনে একটি সামরিক জিপ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়, যাতে দুজন পাকিস্তানি পুলিশ এবং একজন মিলিশিয়া সদস্য গুরুতর আহত হন। এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকাও আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য ‘সেফ জোন’ ছিল না।
রাজনৈতিক ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দলিল পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১ ডিসেম্বর ছিল সেই দিন যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের চাপ সহ্য করার সীমা ভারতের অতিক্রান্ত হয়েছে। তবে তিনি সরাসরি যুদ্ধের ঘোষণা দেননি।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ১ ডিসেম্বরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড ও মুক্তিবাহিনীর হাই কমান্ডের মধ্যে চূড়ান্ত আক্রমণের নকশা বা ‘ফাইনাল অ্যাসল্ট প্ল্যান’ অনুমোদিত হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খান এ দিন রাওয়ালপিন্ডিতে এক জরুরি বৈঠকে স্বীকার করেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ‘ক্রিটিক্যাল’ বা সংকটজনক পর্যায়ে চলে গেছে। ১ ডিসেম্বরেই পাকিস্তান তাদের ১৪তম ডিভিশনকে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী ও অন্যান্য আঞ্চলিক বাহিনীগুলো এর মধ্যেই টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছিল, যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুভমেন্ট বা চলাচলের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
তথ্যসূত্র:

১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর তারিখটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কেবল একটি দিন নয়, বরং এটি ছিল সমরকৌশলের এক চূড়ান্ত পরিবর্তনের দিন, যেখানে আবেগের চেয়ে সামরিক পরিসংখ্যান এবং কৌশলগত অবস্থানই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। এ দিনই মুক্তিবাহিনী ‘হিট অ্যান্ড রান’ বা অতর্কিত হামলার কৌশল থেকে সরে ‘কনভেনশনাল ওয়ার’ বা সম্মুখ সমরের দিকে মোড় নেয়।
ডিসেম্বরের প্রথম এই দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তরে যে প্রতিবেদন জমা পড়েছিল তাতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, কেবল সীমান্তবর্তী এলাকাই নয়, দেশের অভ্যন্তরেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ১ ডিসেম্বর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দেশের চারটি ভিন্ন ভিন্ন রণাঙ্গনে বড় ধরনের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ডিফেন্সিভ পজিশন বা রক্ষণাত্মক ঘাঁটি হারাতে বাধ্য হয়। এ দিনে মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত ব্রিগেডগুলো, বিশেষ করে জেড ফোর্স ও এস ফোর্সের অধীন ব্যাটেলিয়নগুলো তাদের পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নামে।
সিলেট অঞ্চলের কানাইঘাট রণাঙ্গন ছিল ১ ডিসেম্বরের অন্যতম প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র। সেক্টর-৪-এর কমান্ডার মেজর সি আর দত্তের নেতৃত্বে এবং সেক্টর ট্রুপসের সহায়তায় এ অপারেশন পরিচালিত হয়। তবে এ যুদ্ধের মূল নায়ক ছিল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
সামরিক রেকর্ড অনুযায়ী, কানাইঘাট বাজার ও এর আশপাশের এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়েছিল। ১ ডিসেম্বর ভোর ৫টায় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রেভো কোম্পানি যৌথভাবে এ ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়।
এই যুদ্ধের রণকৌশল বিশ্লেষণে দেখা যায়, আক্রমণটি ছিল একটি ক্লাসিক ‘ডাবল এনভেলপমেন্ট’ বা দ্বিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণ। ম্যাপ অনুযায়ী, কানাইঘাট সদরের অবস্থান ছিল সুরমা নদীর তীরে। কৌশলগতভাবে পাকিস্তান বাহিনী কানাইঘাট হাইস্কুল ও ডাকবাংলোতে তাদের মেইন ডিফেন্সিভ পজিশন বা মূল প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করেছিল।
১ ডিসেম্বর আক্রমণের নকশা অনুযায়ী, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘আলফা কোম্পানি’ উত্তর-পূর্ব দিক থেকে সরাসরি বা ‘ফ্রন্টাল অ্যাটাক’ চালায়, যা ছিল মূলত শত্রুকে ব্যস্ত রাখার কৌশল বা ‘ডিকয়’। ঠিক একই সময়ে ‘ব্রাভো কোম্পানি’ অত্যন্ত গোপনে দীর্ঘ পথ ঘুরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর পালানোর পথ বন্ধ করে দেয়। সুরমা নদীর পাড় ধরে এই ‘ব্লকিং পজিশন’ নেওয়ার ফলেই পাকিস্তান বাহিনী কার্যত ফাঁদে পড়ে যায়।

সামনে থেকে আলফা কোম্পানির গুলিবর্ষণ আর পেছন থেকে ব্রাভো কোম্পানির অ্যামবুশ— এই দুইয়ের মাঝে পড়েই পাকিস্তান বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। প্রায় চার ঘণ্টা স্থায়ী এই তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ জন সেনা নিহত হন এবং ১৮ জন গুরুতর আহত অবস্থায় পালিয়ে যান। মুক্তিবাহিনীর ১১ জন বীর যোদ্ধা শহিদ হন।
এ যুদ্ধের বড় গুরুত্ব হলো, এটিই ছিল সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম বড় ধরনের কৌশলগত পরাজয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে ১ ডিসেম্বরের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, এ দিন থেকেই তাদের কাছে খবর আসছিল যে সীমান্ত পোস্টগুলো একে একে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
একই সময়ে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী সেক্টরেও (সেক্টর-১ ও ২) ১ ডিসেম্বর ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। বিশেষ করে ফেনীর বিলোনিয়া পকেট বা ‘বিলোনিয়া বালজ’ যুদ্ধটি সামরিক ইতিহাসে ‘ব্যাটল অব বিলোনিয়া’ নামে পরিচিত, যার চূড়ান্ত পর্যায় এ দিন দৃশ্যমান হয়।
দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাব-সেক্টর কমান্ডারদের নিপুণ পরিকল্পনায় এই এলাকায় অবস্থানরত পাকিস্তান বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়। সামরিক পরিভাষায় একে বলা হয় ‘এনসার্কলমেন্ট’। ১ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিলোনিয়া থেকে পিছু হটে ফেনী শহরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের পালানোর পথগুলো আগেই মাইন দিয়ে আটকে রেখেছিল মুক্তিবাহিনী।
এ দিনে বিলোনিয়া ও পরশুরাম এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ৫০ জন সৈন্য নিহত হন এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়, যার মধ্যে ছিল দুটি ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং প্রচুর চাইনিজ রাইফেল।
মেজর রফিকুল ইসলামের বই থেকে জানা যায়, ১ ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যেই ফেনীর উত্তরাংশ কার্যত মুক্ত হয়ে যায় এবং পাকিস্তান বাহিনী ফেনী শহরের হাইওয়েতে ডিফেন্সিভ পজিশন নিতে বাধ্য হয়। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই মুহূর্ত, যখন পাকিস্তানিরা বুঝতে পারে যে তাদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলো আর নিরাপদ নয়।
পশ্চিমাঞ্চলীয় রণাঙ্গন, বিশেষ করে দর্শনা ও চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে ১ ডিসেম্বরের যুদ্ধ ছিল মূলত আর্টিলারি ও হেভি মেশিনগানের লড়াই। ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকা এই অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭ নম্বর ব্রিগেডের সৈন্যরা বাংকার তৈরি করে অবস্থান নিয়েছিল।

১ ডিসেম্বর সকাল থেকে ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এবং মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি ইউনিট যৌথভাবে পাকিস্তান পজিশনের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। রেকর্ড অনুযায়ী, এ দিন দর্শনা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চারটি বাংকার সরাসরি কামানের গোলায় ধ্বংস হয়। এ আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯ জন সৈন্য ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
এ যুদ্ধের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো— এ আক্রমণের ফলে যশোর ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে দর্শনা সীমান্তের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়্যারলেস মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে জানা যায়, তারা তাদের সদর দপ্তরের কাছে জরুরি বিমান সহায়তা বা ‘এয়ার সাপোর্ট’ চেয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান বিমান বাহিনীর (PAF) সাবের জেটগুলো সেদিন আর উড্ডয়ন করতে পারেনি। কারণ ঢাকা ও কুর্মিটোলার রানওয়েগুলোর ওপর নজরদারি বাড়াতে শুরু করেছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী।
রাজধানী ঢাকায় ১ ডিসেম্বর ছিল ‘আরবান গেরিলা ওয়ারফেয়ার’ বা নগর গেরিলা যুদ্ধের এক নতুন অধ্যায়। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত তিনটি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনে একযোগে অপারেশন চালায় ক্র্যাক প্লাটুন ও বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যরা।
এসব আক্রমণের মধ্যে রামপুরা ও উলন পাওয়ার হাউজের অপারেশন ছিল সবচেয়ে নিখুঁত। ১ ডিসেম্বর রাত ৮টা ৩০ মিনিটে এ অপারেশন চালানো হয়। অপারেশনে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করে ট্রান্সফরমারগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে ঢাকার প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
এ অপারেশনের কৌশলগত দিকটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুৎ না থাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নাইট ভিশন ইকুইপমেন্ট ও সার্চলাইটগুলো অকেজো হয়ে পড়ে, যা তাদের রাতের টহল ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।
এ ছাড়া ১ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় মতিঝিল এলাকায় পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের সামনে একটি সামরিক জিপ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়, যাতে দুজন পাকিস্তানি পুলিশ এবং একজন মিলিশিয়া সদস্য গুরুতর আহত হন। এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকাও আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য ‘সেফ জোন’ ছিল না।
রাজনৈতিক ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দলিল পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১ ডিসেম্বর ছিল সেই দিন যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের চাপ সহ্য করার সীমা ভারতের অতিক্রান্ত হয়েছে। তবে তিনি সরাসরি যুদ্ধের ঘোষণা দেননি।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ১ ডিসেম্বরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড ও মুক্তিবাহিনীর হাই কমান্ডের মধ্যে চূড়ান্ত আক্রমণের নকশা বা ‘ফাইনাল অ্যাসল্ট প্ল্যান’ অনুমোদিত হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খান এ দিন রাওয়ালপিন্ডিতে এক জরুরি বৈঠকে স্বীকার করেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ‘ক্রিটিক্যাল’ বা সংকটজনক পর্যায়ে চলে গেছে। ১ ডিসেম্বরেই পাকিস্তান তাদের ১৪তম ডিভিশনকে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী ও অন্যান্য আঞ্চলিক বাহিনীগুলো এর মধ্যেই টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছিল, যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুভমেন্ট বা চলাচলের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
তথ্যসূত্র:

বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করা হয়েছে। এর ফলে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পুরোপুরি পৃথক হলো।
১২ ঘণ্টা আগে
কমিটির কাছ থেকে প্রতিবেদন গ্রহণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যখন আপনাদের এ কাজটি করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল সামান্য কিছু অনিয়ম হয়তো হয়েছে। কিন্তু আপনারা যে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে এনেছেন তা রীতিমতো ভয়াবহ। কল্পনার একেবারে বাইরে।
১২ ঘণ্টা আগে
সেনাবাহিনীতে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার ১১৪ জন কর্মকর্তা সম্পর্কে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। তাদের (যার জন্য যা প্রযোজ্য) স্বাভাবিক অবসর প্রদান, পদোন্নতি, অবসরপূর্ব পদোন্নতি, বকেয়া বেতন ও ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি দেওয়ার জন্য কমিটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে চারজনকে চাকুরিতে পুনর্বহাল করার জন্য কমিটি সুপারি
১৪ ঘণ্টা আগে
তদন্তে উঠে এসেছে, এ হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত। এর পেছনে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের রক্ষা করতেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ সরাসরি ভূমিকা রেখেছে।
১৪ ঘণ্টা আগে