‘তৌহিদী জনতার’ কাজ সমর্থন করছেন না দুই মাওলানা

ডয়চে ভেলে
ছাত্রী হেনস্তায় অভিযুক্ত ঢাবি কর্মচারীকে ছাড়াতে শাহবাগ থানায় ‘তৌহিদী জনতা’র রাতভর তুলকালাম কাণ্ড।

বাংলাদেশে ‘তৌহিদী জনতা’ পরিচয় দিয়ে নানান বিতর্কিত ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এসব কাজ সমর্থন করছেন না দুই মাওলানা। তাদের একজন বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলছেন, এসব কাজ ইসলামও সমর্থন করে না।

ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘কাউকে ওড়না পরানো, বোরখা পরানো - এই মোরাল পুলিশিংয়ের কাজ কেউ কাউকে দেয়নি। এটা তৌহিদী জনতার কাজ হতে পারে না। আমরা ইসলামের আহ্বান জানাবো৷ ভালো ও সৎ কাজের আহ্বান জানাব। কিন্তু কাউকে বাধ্য করা, জোর করা কোনো ভালো কাজ নয়। ইসলাম এটাকে সমর্থন করে না। আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান ও স্বাধীনতা দিয়েছে৷ সেই স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া যায় না।’

মাওলানা রহমান বলেন, ‘আমার ধারণা কেউ বা কোনো মহল এই তৌহিদী জনতার ব্যানার নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে৷ আবার কেউ তাদের ব্যবহার করছে৷ তাদের জ্ঞানের স্বল্পতাও হতে পারে৷ তারা আসলে ইসলামের বদনাম করছে৷ সরকারের এটা দেখা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘যারা একাত্ববাদে বিশ্বাসী তারা সবাই তৌহিদী জনতা। এই নামে আলাদা কোনো গ্রুপ নেই। যারা ঈমানদার, যারা মুসলামান তারা সবাই তৌহিদী জনতা। ফলে এইভাবে তৌহিদী জনতা শব্দটির অপব্যবহার ঠিক না। এটাকে ব্যানার হিসাবে ব্যবহার করে বিতর্কিক করা চরম নিম্নমানের কাজ।’

‘তৌহিদী জনতার’ পরিচয়ে সবশেষ ঘটনাটি ঘটে বুধবার রাতে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে ওড়না ঠিক করার কথা বলে হেনস্তা করায় বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক কর্মচারী আসিফ অর্নব আটক হওয়ার পর বুধবার রাতে ‘তৌহিদী জনতার' ব্যানারে শাহবাগ থানা ঘেরাও করা হয়৷ তারা হেনস্তাকারীকে ছেড়ে দেয়ার চাপ দেন৷ থানা তাকে না ছাড়লেও বৃহস্পতিবার তাকে আদালত থেকে জামিন দেয়া হয়েছে৷ জামিনের পর তৌহিদী জনতা তাকে ফুলের মালা আর পাগড়ি দিয়ে বরণ করে নেয়৷

জানা গেছে, ছাত্রীটিকে সমঝোতায় বাধ্য করে ওই জামিনের ব্যবস্থা করা হয়। ওই শিক্ষার্থী এখন হলবন্দি হয়ে পড়েছেন। ফোনে অসংখ্য কল আসায় তিনি ফোনও বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতেও বাধ্য হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন, ‘সে মামলা প্রত্যাহারের জন্য স্বেচ্ছায় সমঝোতা করেনি, তবে তাকে বাধ্যও করা হয়নি৷ পরিস্থিতির কারণে সে হয়তো সমঝোতা করেছে৷ তার বিভাগের শিক্ষক ছিলেন, ডিন ছিলেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমরা ঘটনা জানার পরই ব্যবস্থা নিয়েছি৷ মামলা হয়েছে৷ ওই কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তার বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে৷ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে তার কাজ থেকে বিরত রাখতে বলা হয়েছে।’ ‘এখানে যা হয়েছে তা সব জাস্টিস। তবে ক্যাম্পাসে নারীদের নিরাপত্তায় আমরা সতর্ক আছি,’ বলেন তিনি।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনিম তানজিলা বলেন, ‘আসলে এখানে সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির৷ তারা আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সক্রিয় নয়৷ আবার পরিস্থিতি বুঝে তারা চুপ থাকে৷ গা বাঁচিয়ে চলে৷ আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না যে একজন ছাত্রীকে হেনস্তা করার পরও ওই কর্মচারী জামিন পেয়েছেন৷ তার সঙ্গে সমঝোতা করতে ওই ছাত্রীতে বাধ্য করা হয়েছে৷ সে এখন আরো বিপদের মুখে আছে।’

হেফাজতে ইসলামীর নায়েবে আমীরের আহ্বান

হেফাজতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, ‘তৌহিদী জনতার ব্যানারে কোনো বিতর্কিত বা আইনবহির্ভূত কাজ করা যাবে না। কোনো অযৌক্তিক বা অশান্তির কাজ করা যাবে না। এটা আমরা সমর্থন করি না্ এটা যদি কেউ করেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ইসলামের কথা বলি, ইসলামের বিধি-নিষেধের কথা বলি৷ কিন্তু জোর করে চাপিয়ে দেই না৷ জোর করা আমাদের কাজ নয়৷ আমরা অন্যদের জোর জবরদস্তি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।’

তৌহিদী জনতা কারা জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামীর নায়েবে আমীর বলেন, ‘‘যত মুসলমান আছে তারা সবাই তৌহিদী জনতা। আর হেফাজতে ইসলাম তো সকল তৌহিদী জনতার সংগঠন৷ কখনো কখনো হয়তো হেফাজতে ইসলামের ব্যানার ব্যবহার করতে সংকোচ বোধ করেন৷ অথবা নেতৃবৃন্দের অনুমতি নেয়া হয়নি৷ তখন অনেকে তৌহিদী জনতার ব্যানারে কাজ করেন৷ বা কোনো কর্মসূচি পালন করেন৷ জাতীয় পার্টি, বিএনপি বা কোনো রাজনৈতিক দলও তৌহিদী জনতা৷ সবাই তৌহিদী জনতা।’

উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

তৌহিদী জনতা ও তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা, তা জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে সফল হয়নি ডিডাব্লিউ। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় টুরিস্ট পুলিশের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা এ নিয়ে প্রশ্ন করলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জবাব না দিয়ে চলে যান৷ অবশ্য গত মাসে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা তৌহিদী জনতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা সব জনতাকেই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি৷ শুধু এক জনতা তো নয়, বিভিন্ন জনতা বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করছে৷ সব জনতাকেই নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আমাদের৷ এখন কোন জনতা কিসের জন্য সমস্যা করছে আমরা সেগুলো দেখার চেষ্টা করছি।’

অতীতে সরকারের পক্ষ থেকে তৌহিদী জনতার ব্যাপারে কড়া অবস্থানের কথা জানানো হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার এক ফেসবুক পোস্টে আগে ‘তৌহিদী জনতার’ নামে যারা হামলা করেছেন তাদের সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এ কঠোরতার হুঁশিয়ারি অপরাধীদের জন্য, যারা তৌহিদের কথা বলে নিপীড়ন করছে, নৈরাজ্য করছে৷ কিন্তু আগে যেভাবে ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সাধারণ মুসলিমদের নিপীড়ন করা হতো, যার শিকার আমিও হয়েছি তা কোনো মতেই আর পুনরাবৃত্ত হবে না।’

ছদ্মবেশে উগ্রবাদীতা?

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘তৌহিদী জনতা কারা এটা বলা কঠিন৷ তবে এটার ছদ্মবেশে উগ্রবাদীতা থাকতে পারে৷ যারা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চায় না৷ যারা পরিচয় গোপন করে কাজ করতে চায় তারা এই ধরনের ব্যানার ব্যবহার করতে পারে।’

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী হেনস্তার ঘটনায় একজনকে আটকের পর রাতে তৌহিদী জনতার ব্যানারে থানায় গিয়ে একদল মব তৈরি করে৷ তারা আসলে এভাবে প্রকাশ্যে আসতে চায় শক্তি দেখাতে চায়,’ বলেন তিনি।

তার কথা, ‘সরকার শুধু এইসব ঘটনায় বিবৃতি দেয়, ব্যবস্থা নেয় না। সরকারকে এগুলো কঠোর হাতে দমন করতে হবে।’

সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, ‘কিছু লোক আছে যারা মারপিট করতে চায়, ঝামেলা করতে চায়, মব তৈরি করতে চায়। কিন্তু এগুলো আইনের দৃষ্টিতে অন্যায়৷ তাই যখন এই কাজটি তারা করতে যায় তখন নিজেদের তৌহিদী জনতা পরিচয় দেয়৷ তারা বোঝাতে চায় যে তারা আল্লাহর আইনে কাজ করছে৷ তারা একটা সাপোর্ট বা সুবিধা পাওয়ার জন্য এটা করে৷ কিন্তু এটা আল্লাহর আইনে এটা বৈধ কিনা এই প্রশ্ন কিন্তু আপনি তাদের করতে পারবেন না৷ তার এভাবে পার পেয়ে যায়।’

‘সরকার নিজেরা তামাশা করে, তামাশা দেখে৷ এই সরকার একটা দায়িত্বহীন সরকার৷ আগে আমি বলতাম এই সরকার একটা নন-সিরিয়াস সরকার৷ এখন আমি বলছি দায়িত্বহীন সরকার৷ এটা হলো এখন মূল সমস্যা।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, ‘রাষ্ট্রের নারীর পোশাক, নারীর চলাচল, নারীর স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থা নেয়ার কথা ছিলো, যদি সেটা অন্যের ক্ষতি না করে৷ সেটা না করে যারা রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আছেন তারা অন্যায় চর্চ্চাকে হতে দিচ্ছে৷ এটা এই রাষ্ট্রের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।’

‘নারীদের সঙ্গে তৌহিদী জনতার নামে যে আচরণ করা হচ্ছে সেখানে রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ এটা এই বার্তা দেয় যে, এই রাষ্ট্র নারীদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে না৷ নারীরার তাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিকারে রাষ্ট্রের সমর্থন পাচ্ছেনা,’ বলেন তিনি।

‘তৌহিদী জনতা’ পরিচয়ে কিছু বিতর্কিত কাজ

‘তৌহিদী জনতার' কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উত্তরায় বসন্ত উৎসব বন্ধ করে দিতে হয়েছে৷ একই দিনে টাঙ্গাইলের ভুঞাপুরে বসন্ত ও ভালবাসা দিবসে ফুল বিক্রি করায় ফুলের দেকানে হামলা হয় তৌহিদী জনতার ব্যানারে৷ আর ওই ভয়ে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি সেখানে পূর্ব নির্ধারিত ঘুড়ি উৎসব বাতিল করা হয়৷ ঘুড়ি উৎসব বিরোধী একটি লিফলেট ছড়িয়ে দেয়ার পর ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷

১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে লালন স্মরোণসব বন্ধ করা হয় হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে৷ এর আগে নারায়ণগঞ্জে লালন ভক্তদের মিলনমেলা পন্ড করা হয়েছিলো হামলা চালিয়ে।

১০ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের বই রাখায় ‘সব্যসাচী প্রকাশনা'র স্টলে গিয়ে মব তৈরি করে তৌহিদী জনতা৷ ওই স্টলটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়৷

২৮ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নারী ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের প্রতিবাদে তৌহিদী জনতার ব্যানারে মাঠে ভাঙচুর চালানো হয়৷ তারা পরের দিনে ওই ফুটবল ম্যাচ হতে দেয়নি।

গত ১৮ জানুয়ারি পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৪ আগস্টের পর থেকে ৪০টি মাজারের ৪৪ বার হামলা হয়েছে৷ সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে৷ এখানে ১৭টি মাজারে ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছে৷ এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ১০টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে সাতটি হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ ঘামলার ঘটনায় ফৌজদারি মামলায় মোট ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷

আর বিশ্ব সুফি সংস্থা ২৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮০টি মাজারে হামলা হয়েছে।

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন