অসীম ক্ষমতার খুদে প্রাণী

বুলা শরীফ
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২: ২১
নিজের ওজনের চেয়ে ২০ গুণ ওজনের বস্তু বয়ে নিতে পারে পিঁপড়া। ছবি: সংগৃহীত

মানবসভ্যতা ডালপালা মেলার প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে থেকেই খুদে একটি প্রাণী রাজত্ব করছে এই পৃথিবীতে। নাম পিঁপড়া। খুদে প্রাণী হলেও অসীম ক্ষমতা এদের। নিজের ওজনের চেয়ে ২০ গুণ ওজনের বস্তু বয়ে নিতে পারে। পিঁপড়া সব সময় লাইন ধরে দলবদ্ধ হয়ে চলতে পছন্দ করে। দলে নেতৃত্বে থাকে রানি পিঁপড়া। রানি পিঁপড়াকে মেনে চলে সবাই। 

মানুষ যেমন সভ্যতার শুরুতে পশুপালন করে প্রথম কৃষি কাজ শিখেছিল, এই প্রাণীটিও পশুপালন করে। তবে সামান্য পতঙ্গ, তাদের পশুগুলো তো আর গরু-ছাগলের মতো বড় বড় হবে না। খুদে একরকম পোকাদের লালন-পালন করে এরা। এছাড়া উদ্ভিদেরও চাষ করে। তবে সাধারণ উদ্ভিদ নয়, তা এক ধরনের ছত্রাক।

পিঁপড়াদের ‘পশুপালন’ দেখেছিলাম আমার ব্যালকনির গাছপালাতে। অ্যাডেনিয়াম, পর্তুলিকা, রেইনলিলি আর খাটো জাতের কামিনি গাছ আছে আমার ব্যালকনিতে। নতুন নতুন যখন বাগান শুরু করেছি তখন।

হঠাৎ একদিন দেখি পিঁপড়ারা আক্রমণ করেছে টবে, মাটি তুলেছে। এর দুয়েকদিনের মধ্যে দেখি গাছের পাতা আর ছোট ছোট ডালে সাদা সাদা পোকা গিজগিজ করছে। পোকাটা ক্ষতিকর। ডালের পাতা আর কান্ড থেকে রস চুষে খায়। ডালপালা, কুড়ি, ফুল ফল—কিছুই এর হাত থেকে রেহাই পায় না। পোকাটা দেখতে ছারপোকার মতো কিছুটা। গায়ের রঙে তফাৎ।

কী করি? অনলাইনে সার্চ দিলাম। পোকাটার নাম মিলিবাগ। যেখানে যায়, গাছপালা একেবারে ধ্বংস করে ফেলে। কিন্তু এদের দেখে মনে হয় না খুব চালু পোকা। অর্থাৎ গাছের গায়ে কামড়ে থাকে। নড়াচড়া করে খুব কম। যদিও-বা করে, এদের হাঁটার গতি অত্যন্ত শ্লথ।

তাহলে এই পোকা এক গাছ থেকে আরেক গাছে পাড়ি দেয় কীভাবে? তাছাড়া গিরগিটি কিংবা টিকটিকির মতো প্রাণীদের জন্য সহজ শিকার হওয়ার কথা। নিজেদেরই বা তারা রক্ষা করে কীভাবে?

নানা সূত্র থেকে জানতে পারি, এদের নিজেদের কিছুই করতে হয় না। যা করার পিঁপড়ারাই করে। পিঁপড়ারা এদের দেখভাল করে, শত্রুর হাত থেকে বাঁচায়; এক গাছ থেকে আরেক গাছে বয়ে নেওয়ার কাজও পিঁপড়ারা করে।

এমনকি এদের ডিম আর ছানার সুরক্ষাও নিশ্চিত করে পিঁপড়ারা। বানিয়ে দেয় সুরক্ষিত বাসায়। কিন্তু কেন? পরে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মিলিবাগদের নিয়ে পিঁপড়াদের এই কীর্তিকলাপ দেখেছি।

পৃথিবীত অহরহ চলে ‘গিভ অ্যান্ড টেকে’র খেলা। কোনো পশু আমরা তখনই পুষি, যখন তা থেকে মাংস বা দুধ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কিংবা যদি পশুটা ভারবাহী বা পাহারাদার টাইপের হয়।

সেসব উদ্ভিদেরই আমরা চাষ করি, যেগুলো থেকে খাদ্যশস্য বা অর্থকরী ফসল পাওয়া যায়। পিঁপড়ারাও নিশ্চয়ই তেমনটাই করে। পশ্চিমবঙ্গের গবেষক যুধাজিৎ দাশগুপ্তের ‘ছলনার আট পা এবং অন্যান্য’ বইয়ে দারুণ একটা স্টোরি পেলাম পিঁপড়াদের নিয়ে।

তিনি লিখেছেন, মিলিবাগের জন্য নাকি বাসায় বানিয়ে দেয় পিঁপড়ারা, সুরক্ষা দেয়। এর বদলে মিলিবাগের শরীর থেকে নির্গত বর্জ্যপদার্থ নিজেদের করে নেয় পিঁপড়ারা। এই বর্জ্য পদার্থের ভেতরে কিছুটা থাকে মিষ্টি রস। পিঁপড়া সেই মিষ্টি রস মজা করে খায়। যেমন আমরা গুরুর দুধ পান করি, এজন্য গরু লালন-পালন করি।

পিঁপড়াদের পৃথিবীর প্রথম কৃষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন যুধাজিৎ দাশগুপ্তই। বলেছেন, ‘দক্ষিণ আমেরিকার পাতাকাটা পিঁপড়ারা করে ছত্রাকের চাষ। পাতাকাটা পিঁপড়াদের গাছের পাতা কী কাজে লাগে? নিশ্চয়ই এরা পাতা খায় না! তাহলে?’

আসলে পাতাগুলো তারা জমা করে নিজেদের বাসার ভেতর। কিছুদিন পর পাতা পচে যায়। তখন সেই পাতার ওপর ছড়িয়ে দেয় বিশেষ এক জাতের ছত্রাকের বীজ। পচা পাতা সেই ছত্রাকদের দারুণ পছন্দের। তার ওপর ছত্রাকগুলো বেড়ে ওঠে, একসময় ছত্রাকের বীজ হয়। সেই বীজ পিঁপড়ার ছানাদের খুব প্রিয়। মজা করে খায় সেগুলো।

পিঁপড়াদের পোকাপালন বা ছত্রাক চাষের এ ঘটনা কিন্তু আজকের নয়। কোটি কোটি বছর ধরে এটা করে আসছে পিঁপড়ারা। তাই এদের পৃথিবীর প্রথম চাষি বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হয় না।

পিঁপড়াদের চলাফেরা অদ্ভুত। প্রথম পিঁপড়া যে যে পথে যায়, অন্যরা সেই একই রেখা অনুসরণ করে চলে, একচুলও এদিক-সেদিক হবে না। পিঁপড়ারা এই সামাজিক চলাফেরা কিন্তু শুধু চোখে দেখে করে না; চোখে দেখে এতটা সূক্ষ্মভাবে অগ্রগামীকে অনুসরণ করা সম্ভবও নয়। এর পেছনে রয়েছে রসায়নের খেলা।

পিঁপড়াদের আছে ফেরোমন ( এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ) নিঃসরণের ক্ষমতা। পিঁপড়ার দলনেতা চলার পথে ফেরোমন ছড়িয়ে যায়। সেই ফেরোমনের গন্ধ শুঁকে পেছনের পিঁপড়ারা তাকে অনুসরণ করে।

পিঁপড়ার সারির মাঝখানের কোনো স্থানে যদি মুছে ফেলা হয়, তখন দেখা যাবে পেছনের পিঁপড়াগুলো সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফেরোমনের গন্ধ মুছে গেলে চলার পথ ঠিক করতে অসুবিধা হয়। পিঁপড়ার নাক নেই। ফেরোমনের গন্ধ অনুসরণ করার জন্য তারা মাথার সামনের দিকে থাকা অ্যান্টেনা ব্যবহার করে।

ক্ষুদ্র এই প্রাণী অক্লান্ত পরিশ্রমী। পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পিঁপড়া রয়েছে। সব প্রজাতির পিঁপড়াই পরিশ্রমী। পৃথিবীর প্রায় নব্বই ভাগ মৃত কীট-পতঙ্গের সৎকার করে এই পিঁপড়ারা।

কত যে নাম ওদের; পিঁপড়ে, পিঁপড়া, পিপীলি, পিপীলিক, পিপীলিকা। আকার, গায়ের রং, অবস্থান ইত্যাদির বিচারে কেউ লাল পিঁপড়া, কেউ কালো, কেউ কাঠপিঁপড়া, কেউ ডেঁয়ো।

পিঁপড়া নিয়ে প্রবাদ, ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ কিন্তু কম লেখা হয়নি। গিরীন্দ্রশেখর বসু তো ৮২ বছর আগে একটা বই লিখে গেছেন; নাম ‘লালকালো’। নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘কাজের লোক’ ছড়ায় মৌমাছি, পাখি আর পিঁপড়ার কাজকর্মের কথা বলা হয়েছে।

ছোট খোকা বলছে— পিপীলিকা পিপীলিকা/দলবল ছাড়ি একা/কোথা যাও, যাও ভাই বলি। পিপীলিকা উত্তরে বলছে— শীতের সঞ্চয় চাই/খাদ্য খুঁজিতেছি তাই/ছয় পায়ে পিলপিল চলি।

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

ডেঙ্গুতে একদিনে মৌসুমের সর্বোচ্চ ১২ জনের মৃত্যু, নতুন ভর্তি ৭৪০

দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে ৭৪০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

৭ ঘণ্টা আগে

পিআর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে দলগুলোই: প্রেস সচিব

পিআর নাকি বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে- এর সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোই নেবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, সরকারের এ বিষয়ে কম কথা বলাই ভালো।

৭ ঘণ্টা আগে

সরানো হলো জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমানকে

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে বদলি করা হয়েছে। রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

৯ ঘণ্টা আগে

ব্যান্ডউইথ রপ্তানিতে বাংলাদেশের অনুমোদন চেয়ে চিঠি স্টারলিংকের

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ব্যান্ডউইথ সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর অনুমোদন চেয়েছে।

৯ ঘণ্টা আগে