ধরাছোঁয়ার বাইরে ইলিশ, নাগালে আসবে কি দাম?

প্রতিবেদক, রাজনীতি ডটকম
বিশ্বে ইলিশের মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশেরও বেশি হয় বাংলাদেশে | ছবি—সংগৃহীত

ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় ইলিশ মাছ নিয়ে হা-হুতাশের শেষ নেই স্বল্প আয়ের মানুষের। অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য উপদেষ্টা অবশ্য সেই মাছের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। দাম কমলেও তা কি স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালে আসবে?

ভরা মৌসুম হিসেবে এখন ইলিশের দাম কমার আশায় ছিলেন অনেকেই। তবে বাজারের চিত্র ভিন্ন; ১ কেজি আকারের মাছ কিনতে গুনতে হচ্ছে অন্তত দেড় হাজার টাকা।

কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল আওয়াল বললেন, ইলিশের দাম এখনও তেমন কমে নাই; সরবরাহও খুব বাড়ে নাই।

“মাছ হচ্ছে দ্রুত পচনশীল। যদি ইলিশ বেশি ধরা পড়ে, আর দেশের বাইরে রপ্তানি না হয়- তাহলে দাম কমবে। এক কেজি ওজনের মাছ ১ হাজারের কাছাকাছি হবে। তবে এর চেয়ে কমবে না।”

ইলিশ শিকারের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার বর্ণনায় চাঁদপুরের সম্রাট বেপারি বলেন, “এই কয়েকদিন মাছ ধরতে গিয়ে কোনো লাভ হয় নাই। ডিজেলের দাম এতো বেশি যে- সেই অনুপাতে মাছ না পেয়ে আমরা হতাশ।

“দেশের জনসংখ্যা বাড়তেছে, কিন্তু মাছের সংখ্যা নদীতে কমে গেছে। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে, শ্রমিক খরচও বাড়ছে। আগে শ্রমিক নিতে যে খরচ হতো, এখন এর চেয়ে দ্বিগুণ হয়।”

ফেইসবুকে ধাপ্পাবাজি, বাস্তবতা কী

মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার গেল ১১ অগাস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইলিশ নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরেন। বলছিলেন, দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে তারপর ইলিশ রপ্তানি করা হবে।

ফরিদার কথায়, “দেশের মানুষ যাতে ইলিশ মাছ পায় এবং দাম কমে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে। দেশের মানুষ ইলিশ পাবে না, আর রপ্তানি হবে সেটা হতে পারে না।”

গত কয়েক বছর ধরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রপ্তানি করে আসছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। গত পূজার সময়েও ভারতে ইলিশের প্রথম যে চালান গেছে, একই দিন তার চেয়ে বেশি দামে ইলিশ কিনতে হয়েছে বরিশালবাসীকে।

এছাড়া পয়লা বৈশাখ আসার আগ দিয়েও এই মাছে দাম চলে যায় সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে। চলতি বছরে অবশ্য বৈশাখ পাড়ি দেওয়ার পর এই মাছের দাম কমেনি।

“কিন্তু ব্যবসায়ীদের নিশ্চিত একটা বড় সিন্ডিকেট আছে- যারা দাম কমানোর পক্ষে না। এজন্যই দাম কমতেছে না। নদী থেকে অন্য মাছও তো ধরে, সেগুলোর দাম তো কম; শুধু ইলিশের দামই বেশি।”

বিক্রেতা দুলালকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “এক কেজির একটা ইলিশ কয়েকদিন আগেও ১৭০০ টাকা বিক্রি করছি, আজ ১৫০০ টাকা। দাম তো ২০০ টাকা কমছেই।

“তবে যদি ইলিশ বেশি ধরা পরে, তাহলে দাম আরও কমবে। নাহয় দাম কমার সুযোগ নাই্। ভারতে ইলিশ রপ্তানি করার সঙ্গে দেশের বাজারে ইলিশের দাম একেবারে কমে যাবে- এটা ভুল ধারণা।”

“ইলিশের দাম এক টাকাও কমে নাই। ফেইসবুকে দেখেছি, তাই আশা ছিল কমবে; কিন্তু বাজারে এসে দেখছি উল্টা চিত্র। আসলে সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে দাম কমানো সম্ভব না। অনেকগুলো হাত হয়ে বাজারে মাছ আসে।”

মারুফ নামের এক ইলিশ বিক্রেতা বললেন, “ইলিশের দাম খুব একটা কমবে না। কারণ ইলিশের চাহিদা সবসময়ই থাকে।”

তার দোকানের সামনের বিভিন্ন আকারের ইলিশের মূল্যতালিকা ঝুলছিল। তাতে দেখা যায়, দেড় কেজি আকারের প্রতি কেজির দাম ২৫০০ টাকা, এক কেজি আকারের প্রতি কেজির দাম ১৭০০ টাকা, ৮০০ গ্রাম আকারের প্রতি কেজির দাম ১৪০০ টাকা এবং ৬০০ গ্রাম আকারের প্রতি কেজি ইলিশের দাম ১৩০০ টাকা।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের শুক্রবারের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাজারে ইলিশের সর্বনিম্ন মূল্য ৮০০ টাকা। এক মাস আগে এই দাম ছিল ৭০০ টাকা এবং এক বছর আগে এই সময়ে সর্বনিম্ন দাম ছিল ৬৫০ টাকা।

রপ্তানির প্রভাব কতটা?

দুর্গাপূজার সময় ভারতে ইলিশ রপ্তানির কারণে বাংলাদেশের বাজারে কেমন প্রভাব পড়ে?

এ প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিজাম উদ্দিন বলেন, “এ কারণে দাম বাড়ে নাই। যখন ইলিশ কম থাকে, তখন দাম এমনিতেই বেশি থাকে।

“ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে দাম কম। ব্যবসায়ীদের ভারতে রপ্তানি করলে লাভ অনেক বেশি হতো, দেশেও ডলার আসতো আগে।”

নিজাম বলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে ১০ থেকে ১৫ দিন ভারতে ইলিশ রপ্তানির সুযোগ পেয়ে আসছিলেন তারা।

“ব্যবসায়ীরাও ভারতে কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করতে পারতো। এমনিতে ইলিশ রপ্তানি সবসময় বন্ধই থাকে।”

ইলিশের দাম বর্তমানে কিছুটা কমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মৌসুম শুরু হওয়ায় কেজি প্রতি ৩০০ টাকার মতো করে দাম কমেছে। তবে রপ্তানি বন্ধ করার কারণে কমেছে- বিষয়টা এমন না।”

উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমছেই

নদীতে দখল-দূষণ, ডুবোচর ও বাঁধ-সেতুসহ নানা অবকাঠামোর প্রভাবে নদীতে ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাতে মাছটির প্রজনন হুমকির মুখে পড়ছে, ভাটা পড়ছে উৎপাদন।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল বারী বলেন, “নদীতে দূষণ বাড়তেছে, বঙ্গোপসাগর থেকে যেসব জায়গা দিয়ে মাছ ঢুকে- ভোলা, হাতিয়া এসব জায়গায় প্রচুর পরিমাণে ডুবোচর তৈরি হয়েছে। এজন্য মাছ সহজে ঢুকতে পারছে না।

“এছাড়াও বৃষ্টির পরিমাণ কম থাকায় পানির লবণাক্ততা না কাটে তাহলে ইলিশ মাছ আসে না। এরপর নির্বিচারে জাটকা ও মা ইলিশ নিধন করা হয়। এসব নানা কারণে মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।”

তবে তার কিছু দাবি অনুমানভিত্তিক বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হাসান ফারুক।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আগের চেয়ে ইলিশের পরিমাণ কমছে না, বরং বাড়ছে। তবে প্রবৃদ্ধির হার হয়ত কমেছে। জেলেদের তো অনুমানভিত্তিক কথা। তারা দেখা যাবে এত মাসে কম পেয়েছে, আবার আরেক মাসে বেশি পেয়েছে।”

ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫.৩৩ লাখ মেট্রিক টন, যা আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার ৩.০২ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫.৫০ লাখ মেট্রিক টন, প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.২৩ শতাংশ।

২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫.৬৫ লাখ মেট্রিক টন, প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৭৩ শতাংশ।

২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫.৬৭ লাখ মেট্রিক টন, প্রবৃদ্ধির হার কমে হয়েছে ০.৩৫ শতাংশ।

আর ২০২২-২৩ ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫.৭১ লাখ মেট্রিক টন, প্রবৃদ্ধির হার হয়েছে ০.৭০ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞানের শিক্ষক হাসান ফারুক বলেন, “জাটকা ইলিশ ও মা ইলিশ না ধরার জন্য সরকারের অনেক কর্মসূচি রয়েছে। তাছাড়া দেখভালের জন্য জনবলও আছে।”

তবে ইলিশ ধরার ওপর বাংলাদেশ ও ভারত যে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে- তাতে সমন্বয় না থাকায় নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

এবছর বাংলাদেশের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় ২০ মে, শেষ হয় ২৩ জুলাই। আর ভারতে ৬১ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় ১৫ এপ্রিল, শেষ হয় ১৪ জুন।

ফলে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ভারতের জেলেরা ৩৮ দিন বাংলাদেশ জলসীমায় ঢুকে ইলিশসহ অন্য মাছ ধরার সুযোগ পান বলে ভাষ্য ট্রলারমালিক ও জেলেদের।

দামের হেরফের

ইলিশের জন্য চাঁদপুরের সুখ্যাতি থাকলেও সেখানকার দাম ঢাকার চাইতেও বেশি। রোববার চাঁদপুরে ইলিশের দাম কেজিতে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দেখা গেছে।

সেদিন রাজধানীর অদূরের জেলাটিতে ১ কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকায়। আর দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বেচা হচ্ছিল ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকায়।

চাঁদপুরে দাম বেশি হওয়ার কারণ কী? সেখানকার মৎস্য বণিক নেতা আবদুল বারী বলেন, “ঢাকায় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাছ যায়। এগুলো মিক্সিং মাছ। চাঁদপুরের মাছের দাম বেশি। ঢাকায় চাঁদপুরের মাছ বলে বিক্রি করবে, কিন্তু সেটা চাঁদপুরের না।

আবার নদী ও সাগরের ইলিশের দামেও ভিন্নতা আছে

দেখতে এক হলেও নদীর ইলিশ আর সাগরের ইলিশের স্বাদ যেমন ভিন্ন, তেমনই দামও ভিন্ন জানিয়ে মৎস্য গবেষক হাসান ফারুক বলেন, “সাগরের ইলিশের চেয়ে নদীর যে ইলিশটা সেটার স্বাদ অনেক বেশি। তাই দামও বেশি।

“কিন্তু বাজারের সাধারণ ক্রেতারা চিহ্নিত করার সুযোগ খুব কম- কোনটা সাগরের আর কোনটা নদীর। দেশে যত ইলিশ ধরা পরে তার ৬০ ভাগ হচ্ছে সাগরের ইলিশ।”

ডিজেলের দামের ‘বড় প্রভাব’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাগরগামী জালসহ একটা বড় ফিশিং ট্রলার বানাতে খরচ লেগে যায় প্রায় এক কোটি টাকা। একটি ট্রলারে ২০ জন গিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন মাছ শিকার করে। এই সময়টাতে তাদের খাওয়া-দাওয়ায় যে খরচ হয়, সেটা আর জ্বালানি তেলের খরচ মিলিয়ে আগের তুলনায় খরচ বেড়েছে বহুগুণ।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল বারীর বলেন, “জ্বালানি তেলের দাম তো অনেক বাড়ছে। চাল-ডাল-তেলের দামও বেশি। ২০০৮ সালে ট্রলারের প্রতি ট্রিপে খরচ যেত ৫০ হাজার টাকা। এখন লাগে ৪ লাখ টাকা।

“সাগরগামী ট্রলারে লার্জ স্কেলে ফিশিং করে। এরা মাছ পেলে দাম অনেক কমে যেত। এরাও এবার মাছ খুব বেশি পাচ্ছে না। মাছ পচনশীল। তাই চাহিদা অনুযায়ী মাছ ধরা পড়লে দাম বাড়ানোর সুযোগ নাই।”

তিনি জানান, চাঁদপুরে বা আশপাশের নদী থেকে নিয়মিত মাছ ধরা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। একটি নৌকায় সাতজনের দুই বেলা খাবার আর জ্বালানি তেলসহ সব মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। মাছ ধরার পর বিক্রি শেষে পোষাচ্ছে না তাদের।

ad
ad

অর্থের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

এসএমই উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের স্কিলস ফর ইন্ডাস্ট্রি কম্পিটিটিভনেস অ্যান্ড ইনোভেশন প্রোগ্রামের আওতায় সোমবার (১০ নভেম্বর) এ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্টের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ চলবে মাসব্যাপী।

৩ দিন আগে

হেরিটেজ সুইটসের ৩য় শাখা বসুন্ধরা ‘ই’ ব্লকে

প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড হেরিটেজ সুইটসের তৃতীয় শাখা যাত্রা শুরু করল রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। বসুন্ধরার ‘ই’ ব্লকের ঢালী কাঁচাবাজার ও আশপাশের বাসিন্দাদের জন্য এ শাখা হবে ঐতিহ্য, স্বাদ ও আনন্দের মিলনস্থল।

৩ দিন আগে

জেট ফুয়েলের দাম আরো বাড়ল

রবিবার (৯ নভেম্বর) বিইআরসি সচিব মো. নজরুল ইসলাম সরকার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন দর নির্ধারণের বিষয়টি জানানো হয়েছে। যা কার্যকর হবে আগামীকাল ৯ নভেম্বর রাত ১২টা থেকে এবং পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

৪ দিন আগে

পে কমিশনের সিদ্ধান্ত আগামী সরকারের: অর্থ উপদেষ্টা

উপদেষ্টা বলেন, পে কমিশনের ব্যাপারটা আছে। এটা নিয়ে আমরা এখন কিছু বলতে পারি না। ওটা দেখা যাক কতদূর যায়। আমরা ইনিশিয়েট করে ফেলেছি। কিন্তু সেটা আগামী সরকার হয়তো করতে পারে।

৪ দিন আগে