ভোটের আগে জোট, পর্দার আড়ালে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’

বিবিসি বাংলা

আগামী নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন দলের মধ্যে জোট বা সমঝোতার আলোচনা যেমন আছে, তেমনি নির্বাচনের পর সরকার গঠনের সময় সেখানে সব দলের প্রতিনিধিত্ব যাতে থাকে এরকম একটা বিষয়ও আলোচনায় উঠে এসেছে।

"একটা তৎপরতা চালাচ্ছি, সেটা অভ্যন্তরীণভাবে বা বলতে পারেন কিছুটা পর্দার আড়াল থেকে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দল আমরা যেন নিজেরা একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মধ্যে দিয়ে নির্বাচনটা করতে পারি এবং নির্বাচন পরবর্তী যে সরকার গঠন হবে সে সরকারে যেন গণঅভ্যুত্থানে অংশীজন সকলের একটা প্রতিনিধিত্ব থাকে। যেটা বিএনপির ঘোষণা যে জাতীয় সরকারের সাথে অনেকটা মিল আছে"।

আগামী নির্বাচনের আগে জোটের রাজনীতি এবং নতুন জোট গঠন প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নূর এই কথা বলেছেন।

জোটে থেকে ভোটে অংশ নেওয়া এবং নির্বাচন পরবর্তী সরকারে জায়গা পাওয়ার আলোচনা সমান্তরালে চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "নির্বাচন করাটাই কিন্তু এবার সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ নয়। নির্বাচনের পরেও এই দেশকে স্থিতিশীল রাখা, দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি এবং সরকারের স্ট্যাবিলিটি ধরে রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে"।

গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত তরুণদের দল এনসিপির সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদ ও আরো কয়েকটি দল মিলে নির্বাচনী জোট গঠনের আলোচনা হয়েছে। আবার বিএনপির সঙ্গেও যুগপৎ আন্দোলনের শরিক হিসেবে আলাপ-আলোচনায় অংশ নিয়েছে নুরুল হক নূরের গণঅধিকার পরিষদ।

নির্বাচনমুখী দলগুলো সবাই অতীতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাইরে রাখার ব্যাপারে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলগুলোর একটা মতৈক্য আছে।

আলাদা জোটে নির্বাচন করা, আবার ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার আলোচনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করেননি। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, রাজনীতিতে আলোচনা ইতিবাচক।

"পলিটিক্সে ডায়ালগ চলে। দ্যাট ইজ অ্যা বিউটি অফ পলিটিক্স। এ ডায়ালগ বন্ধ হয়ে গেলেই তো দেশে স্বৈরাচারের জন্ম হয়। এ ডায়ালগ হবে। তারপরে ইলেকশনের সময়ে গিয়ে একটা ফরমেশন হবে"।

বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, "আমরা তাদেরকে সাথে নিয়ে ইলেকশন করবো, জাতীয় সরকার গঠন করবো, আপার হাউজ (জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ) করবো এই প্রতিশ্রুতি আছে"।

"আমরা তো বলেছি ন্যাশনাল গর্ভনমেন্ট হবে। আমরা তো বলি নাই যে বিএনপি গর্ভমেন্ট হবে। এটাতো জাতির কাছে কমিটমেন্ট, একত্রিশ দফার মধ্যেও আছে এটা। সুতরাং ওইটা কোনো সাবজেক্ট না। সাবজেক্ট হলো এখনকার ইলেকশনটা। কত সিট দেব আর কত সিট ফেরত নিয়ে আসতে পারবো- সেইটাই হলো আমাদের হিসাব," বলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।

আলোচনায় তিন জোট

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের পতনের লক্ষ্যে বিএনপির নেতৃত্বে যে দলগুলো যুগপৎ আন্দোলন করেছে, তারাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভিন্ন ভিন্ন জোট গঠন করে এবার ভোটের লড়াইয়ে মাঠে নামছে।

নতুন বাস্তবতায় অতীতে নির্বাচনী শরিক দল জামায়াতের জোটই এবার ভোটের মাঠে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে আসতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জামায়াতের নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক আটটি দল একযোগে মাঠে নেমেছে।

আসন সমঝোতার মাধ্যমে বিএনপির নতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক বেশকিছু দলের জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।

এছাড়া গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত তরুণদের দল এনসিপির সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদ এবং আরো কয়েকটি দল মিলে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের আলোচনাও আছে।

জামায়াতের সঙ্গে, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ আটটি ইসলামপন্থি দল এই জোটে একতাবদ্ধ। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর এই জোট এখন বিভাগীয় সমাবেশ করছে।

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর অন্যতম শরিক ইসলামী আন্দোলনের একজন যুগ্ম মহাসচিব আশরাফুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, এটি নির্বাচনকে ঘিরে এক ধরনের সমঝোতা।

"সমঝোতা হইলো, ইসলামের নামে যত প্রতিনিধিত্বশীল দল আছে তাদের একটাই বাক্স থাকবে। এখানে হয়তো ইসলামী আন্দোলন থাকবে অথবা জামায়াত অথবা খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ বা আমাদের জোটসঙ্গী আরো যারা আছে এদের যেকোনো একজন প্রার্থী একটা আসনে দাঁড়াবে। এই লক্ষ্যেই আমাদের পথচলা"।

অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নতুন শক্তি হিসেবে সামনে আসতে চায়। গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে এনসিপির একটি জোট গঠনের তৎপরতা শুরু হলেও সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এখন পর্যন্ত জোটের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। যে রাজনৈতিক দল জুলাই সনদের প্রতি ইতিবাচক এবং বাস্তবায়নের প্রতি আগ্রহী হবে তাদের সাথে আমাদের কৌশলগত অ্যালায়েন্স হইতে পারে"।

মি. আদীবের ভাষায়, "আগে গতানুগতিক যে নির্বাচনী জোট হতো এবার সেরকম জোট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ যেহেতু আরপিও সংশোধন করে প্রত্যেক দলকে তার নির্দিষ্ট মার্কায় অংশগ্রহণ করতে হবে সেই যায়গা থেকে এবার কৌশলগত অ্যালায়েন্স হবে"।

এনসিপি নেতা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রত্যেকটা দলের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কৌশল থাকবে। আবার জুলাই গণঅভ্যুত্থান বা আধিপত্যবিরোধী একটা কৌশলগত অ্যালায়েন্স থাকবে। এই দুটো দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই এই কৌশল নিয়ে জোটের বিষয়ে সামনের দিকে আগানো হবে।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিএনপি এবং জামায়াত দুই ফ্রন্টে দুটি জোট সারাদেশে ভোটের মাঠে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলেই তারা ধারণা করছেন। ফলে নতুন একটি জোট করলেও তারা ভবিষ্যত বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিএনপি বা জামায়াতের নেতৃত্বে যেকোনো এক জোটের সঙ্গে সমঝোতা করবেন।

"একটা বাস্তবতা এই মুহূর্তে যে একটা তৃতীয় জোট গঠন করে সরকার গঠন খুব ডিফিকাল্ট, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। তাহলে কোনো একটা ফ্রন্টের সাথে শেষ পর্যন্ত বোঝাপড়া বা আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে যেতে হবে, সেটা বিএনপির ফ্রন্ট হোক বা জামায়াতের ফ্রন্ট হোক। এইগুলোর একটা বোঝাপড়া আছে"।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, গণফোরাম, এলডিপি, বিজেপিসহ বাম ও ডানপন্থি কিছু দল একজোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে, বৃহস্পতিবার নতুন করে ৩৬টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পরও ২৮টি আসন ফাঁকা রেখেছে বিএনপি। দলের নেতারা বলছেন, জোটের শরিকদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য আসনগুলো রাখা হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সিনিয়র নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বিবিসিকে বলেন, তফসিল ঘোষণার পরই জোটের রূপরেখা পুরোপুরি স্পষ্ট হবে।

"বিএনপি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল। যুগপৎ আন্দোলনে যারা ছিল তাদের জন্য কিছু সিট আমরা রেখেছি। কিন্তু ইলেকশন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে নিজের মার্কা নিয়ে ভোট করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে তাদের মার্কাতো পপুলার না। ধানের শীষ নিয়ে ইলেকশন করা এক জিনিস, আর ওদের মার্কা নিয়ে ইলেকশন করা অন্য জিনিস। সেটা নিয়ে একটা কনফিউশন আছে"।

বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলছেন যেকোনো আলোচনা-সমঝোতার ক্ষেত্রে দলের প্রাধান্য তুলে ধরে বলেন, "এই যে জোটগুলোর মধ্যে একটা এন্টিকান্ট্রি-দেশদ্রোহিতার একটা জোট গঠন হচ্ছে। আবার দেশপ্রেমিকের একটা জোট গঠন হচ্ছে। ডেফিনেটলি দেশ প্রেমিকের জোটের সঙ্গে আমাদের নেগোসিয়েশন হবে"।

খণ্ডিত জাতীয় পার্টির ভিন্ন জোট

এদিকে বিভক্ত জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বের অংশ সম্প্রতি কয়েকটি দলের সঙ্গে মিলে ভিন্ন একটি জোট গঠনের তৎপরতা শুরু করেছে।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপি এবং আরো কয়েকটি নিবন্ধিত দলসহ ১৬টি দলের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠকও হয়েছে। জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ নেতৃত্বাধীন অংশের নির্বাহী চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেন, "নির্বাচন করি অথবা না করি, হোক বা না হোক, নির্বাচন না করলেও আগামীতে একটা স্বচ্ছ রাজনৈতিক কর্মসূচি জনগণের সামনে উপস্থাপনের জন্যই মূলত এই জোটটা করা আমাদের উদ্দেশ্য"।

যদিও এই দলটি জাতীয় পাটি থেকে খণ্ডিত হয়েছে, নির্বাচন কমিশনও তাদের আনুষ্ঠানিক আলোচনায় ডাকেনি। গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো আওয়ামী লীগের 'দোসর' আখ্যা দিয়ে জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা চৌদ্দ দলকে নির্বাচনে সুযোগ দেওয়ার বিপক্ষে।

মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেন, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হলে সবাইকে নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে, না হলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

"আমরা যে আলাপ করছি তাতে বুঝলাম বিদেশিরা সবাই সবাই চায় একটা ইনক্লুসিভ নির্বাচন। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন যাতে নির্বাচনের পর একটা স্টেবল গর্ভমেন্ট হয়। যাতে একটা স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে আসে"।

"তো স্থিতিশীল অবস্থা যদি ফিরে আসতে হয় তাহলে সবাইকে নিয়েই নির্বাচন করতে হবে। কারণ আপনি জানেন আজ যদি নির্বাচন হয় একটা বড় দলকে যদি আপনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ না দেন তারাতো বিকল্প রাস্তা খুঁজবে। সেই বিকল্প রাস্তা তো কনস্ট্রাকটিভ রাস্তা হবে না"।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

খালেদা জিয়ার অসুস্থতার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই : আমীর খসরু

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানী কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন।

১৮ ঘণ্টা আগে

‘ফ্যাসিবাদীরা বিদায় নিয়েছে, ফ্যাসিবাদ এখনো বিদায় নেয়নি’

তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো বিশেষ দলের বিজয় চাচ্ছি না, আট দলের বিজয়ও চাচ্ছি না। আমরা বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিজয় চাই। সেই আকাঙ্ক্ষার বিজয় হবে কোরআনের আইনের মাধ্যমে ইনশাআল্লাহ। গ্রাম থেকে বিজয়ের বাঁশি বাজানো হবে। আগামীর বাংলাদেশ হবে কোরআনের বাংলাদেশ।

১৯ ঘণ্টা আগে

নির্জন কারাগারেই খালেদা জিয়ার রোগের সূচনা: মির্জা ফখরুল

তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া কয়েক সপ্তাহ ধরে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে রয়েছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অত্যন্ত উচ্চমানের চিকিৎসকরা তার চিকিৎসা করছেন। কিন্তু এই চিকিৎসা আরও উন্নত হাসপাতালে করা প্রয়োজন বলে তাকে ইংল্যান্ডের হাসপাতালে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

১ দিন আগে

আলোচনায় জামায়াতের হিন্দু প্রার্থী, কী বার্তা দিচ্ছে দলটি?

ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়ে ঠিক কী বার্তা দিতে চাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী? দলটির রাজনৈতিক স্ট্রাটেজিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে কি না বা আর কোনো আসনে ভিন্নধর্মের কাউকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হবে কি না এসব প্রশ্নও সামনে আসছে।

১ দিন আগে